তুই ঠিক করিস ওভাবে?
হ্যাঁ, যখন দরকার হয়। খুব সহজ, আমার আব্বা আমাকে শিখিয়ে দিয়েছেন।
স্যার চুপ করে রইলেন। ক্লাস এইটের ছেলেকে যে-আব্বা মেইন সুইচ খোলা শিখিয়েছেন তাঁকে একবার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল।
আর বই বাঁধাইয়ের কথা কী বললি?
হ্যাঁ, আমি বইও বাঁধাই করতে পারি। আমাদের বাসায় অনেক বই ছিঁড়ে গিয়েছিল, তাই আমার আব্বা আমাকে বলেছিলেন আমি যদি বই বাঁধাই করি, তা না হলে দুটো বই বাঁধাই করার জন্যে এক টাকা করে দেবেন। প্রথম প্রথম খুব, বিচ্ছিরি হতো, পরে আমি বুক বাইন্ডিংয়ের দোকানে বসে থেকে দেখে দেখে শিখেছি। সেলাই করার পর শুধু প্রেস থেকে কাটিয়ে আনতে হয়, এখন আমি দোকানের মতো করে করতে পারি।
ও! খুব ভাল। স্যার ক্লাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোরা আর কেউ বই বাঁধাই করতে পারিস?
একটি ছেলে হাত তুলল, ওর আব্বা বুক বাইন্ডার, কাজেই সে তো পারবেই। স্যার বললেন, সবারই কিছু কিছু সত্যিকারের কাজ জানা উচিত। এখন তোরা ছোট আছিস, বড়রা তোদের কিছু করতে দেবে না, কিন্তু সুযোগ পেলে শিখে নিবি। তারপর দীপুর দিকে তাকিয়ে বললেন, নে, তোর লেকচার শেষ, টাইম ওভার। ভালই বলেছিস। একটু থেমে বললেন, কয় ভাইবোন তোরা?
আমি একাই। আমাদের বাসায় শুধু আমি আর আমার আব্বা।
তোর আম্মা?
মুহূর্তের জন্যে দীপু থেমে গেল। ও জানে, যেই সে বলবে তার আম্মা মারা গেছেন, অমনি সবাই কেমন করে জানি তার দিকে তাকাবে ওর জন্যে সবার মায়া হবে। এটা ওর একটুও ভাল লাগে না। ওর আম্মার কথাও মনে নেই, কখনও দেখেওনিঃ আম্মার জন্যে ওর কখনও মন খারাপও হয়নি, কিন্তু সবাই মনে করবে ও বুঝি খুব দুঃখী। দীপু একটু দ্বিধা করে বলল, আমার আম্মার মারা গেছেন।
ও! স্যার খুব অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন, আর দীপু যা ভেবেছিল ঠিক তা-ই হল। সারা ক্লাস হঠাৎ করে একেবারে চুপ করে গেল। কয়েক মুহূর্ত কোনো শব্দ নেই, সমস্ত ক্লাস চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। দীপু একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমার আব্বা খুব ভাল, আমার আম্মা নেই বলে আমার কোনো অসুবিধা হয় না।
ও! স্যার একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, কবে মারা গেছেন তোর আম্মা?
মনে নেই আমার, আমি কোনোদিন দেখিনি।
হুম! স্যার খানিকক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকে বললেন, এবার তোর নামটা আবার বল দেখি খাতায় লিখে নিই।
দীপু তার নাম বলল, মুহম্মদ আমিনুল আলম।
তোর আব্বা কি তোকে মুহম্মদ আমিনুল আলম বলে ডাকেন?
না, দীপু বলে ডাকেন।
কী বললি? স্যার চোখ কুঁচকে তাকালেন। দীপু।
অ্যাঁ? দীপু? আমাদের যে আরেকটা দীপু আছে! দুইটা দীপু হয়ে গেল যে, কী মুশকিল! কোথায় এক নাম্বার দীপু?
ক্লাসে কয়েকটা ছেলে মিলে একজনকে ঠেলে দাঁড় করিয়ে দিল এবং বলল, এই যে, এই যে দীপু।
স্যার মুখ গম্ভীর করে বললেন, তা হলে কী করা যায়? দুজনের এক নাম হয়ে গেলে তো মুশকিল! একজনের অঙ্ক ভুল হয়ে গেলে আরেকজন পিটুনি খাবে যে!
স্যারের মুখ দেখে মনে হল সত্যিই বুঝি এটি একটি বড় সমস্যা। একজন হালকা পাতলা ছেলে হাত তুলে বলল, নাম্বার দিয়ে দেন দুজনের। একজন এক নাম্বার, একজন দুই নাম্বার।
সারা ক্লাস মাথা নেড়ে সায় দিল। কাজেই দীপুর আর কিছু বলার থাকল না।
স্যার একটু হেসে বললেন, তা হলে তুই দীপু নাম্বার টু।
সেই থেকে দীপু আর দীপু রইল না, হয়ে গেল দীপু নাম্বার টু।
নতুন স্কুলে এসে এবারে দীপু খুব তাড়াতাড়ি সবার সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলল। সাধারণত এরকমটি হয় না, কিন্তু ওদের এই ক্লাসটি সত্যিই ভাল। বোধ হয় ক্লাস টীচারটি ভাল বলেই। শুধু একটি ছেলের সাথে তার গন্ডগোল বেধে গেল প্রথম দিন থেকেই। ছেলেটি বয়সে একটু বড়। স্বাস্থ্য খুব ভাল নয়, কিন্তু বোঝা যায় গায়ে খুব জোর। নাম তারিক, ছেলেরা আড়ালে তারিক গুন্ডা বলে ডাকে। সামনাসামনি ডেকে ফেললেও সে খুব একটা রাগ হয় না। বরং একটু খুশিই হয় বলে মনে হয়। প্রথম দিনেই তারিক এসে দীপুর পেছনে চাটি মেরে জিজ্ঞেস করল, এই, তুই বই বাঁধাই করতে পারিস?
দীপু চটে উঠলেও ঠাণ্ডা গলায় বলল, খুব বেশি খাতির না হলে আমি কাউকে তুই করে বলি না। তোমার সাথে আমার এখনও খুব বেশি খাতির হয়নি।
তারিক হলুদ দাঁত বের করে হেসে বলল, খাতির-ফাতির বুঝি না, আমি সবাইকে তুই করে বলি, তোকেও বলব।
ঠিক আছে বলো, আমিও বলব।
কী বলবি?
আমি তুই করে বলব।
আমাকে তুই করে বলবি?
একশবার।
দীপুর পাশে বসে থাকা ছেলেটি, বাবু নাম, দীপুকে একটা চিমটি কাটল। কিন্তু দীপু তেমন গা করল না। ও জানে, এখন সে যদি তারিককে জোর খাটাতে দেয়, সে বরাবর জোর খাঁটিয়ে যাবে। তারিক খানিকক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু বলে চলে গেল।
পাশে বসে থাকা বাবু ফিসফিস করে বলল, সর্বনাশ! তারিকের সাথে ঝগড়া করতে চাইছ?
কে বলল আমি ঝগড়া করতে চাইছি?
ও যা বলে শুনে যাও, এ ছাড়া বাবা বারোটা বাজিয়ে দেবে।
কী করবে? পেটাবে?
ওকে চেন না তুমি, ও সব করতে পারে। একবার মিউনিসিপ্যাল স্কুলের খেলার পর ওদের হাফ ব্যাককে চাকু মেরেছিল, জান?
দীপু কিছু বলল না। সব স্কুলেই এরকম একটি-দুটি ছেলে থাকে, গায়ে বেশি জোর বলে নিরীহ ভাল ছেলেগুলোকে উৎপাত করে বেড়ায়। দীপু যদি একটু নরম হয়ে থাকে, তা হলেই তারিক বেশি কিছু বলবে না, কিন্তু কেন দীপু নরম হয়ে থাকবে?