সবাই অবাক হয়ে দীপুকে দেখছিল। সে যে এরকম করে কথা বলতে পারে কে জানত! নেহায়েত দীপুকে খুব ভাল করে চেনে, নইলে বিশ্বাস করে ফেলত দীপু সত্যি টাকার জন্যে এরকম করছে!
লোকগুলো রাজি হোক দীপু চাচ্ছিল না, কিন্তু রাজি হয়ে গেল। বন্দুকটা ফেলে দিলেই ওরা তারিকের হাতে টাকা আর ঘড়ি দিয়ে উপরে পাঠিয়ে দেবে।
দীপু রাজি হল না, উঁহু বিশ্বাস করি না। বন্দুকটা ফেলে দিলে তোমরা শুধু তারিককে ছেড়ে দেবে, টাকা দেবে না।
বলছি দেব।
দেবে না। বললাম তো দেব।
বিশ্বাস করি না! আগে টাকা দিয়ে তারিককে পাঠাও আমরা বন্দুক ফেলে দেব, কথা দিলাম।
সাহেব রেগেমেগে কী যেন বলল, তখন দীপু আরেকটু নরম হল। বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, দু’জনের কথাই থাক। তারিক উঠে আসবে একপাশ দিয়ে, আরেক পাশ দিয়ে বন্দুকটা নামাব।
দীপুকে নিরাশ করে দিয়ে ওরা রাজি হয়ে গেল। এতেই ওর খুশ হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তখনও সে চিন্তা করে যাচ্ছিল এর থেকে ভাল কিছু করা যায় কি না। তক্ষুণি তার মাথায় আরেকটা বুদ্ধি খেলে গেল, কিন্তু একটু সময় দরকার। সময়টা কীভাবে পাবে? চিৎকার করে বলল, তারিক টাকা না গুনে নিস না, আর আসার সময় আমাদের শার্টগুলো নিয়ে আসিস, শীতে মারা যাচ্ছি।
তারিক বলল, আচ্ছা।
দীপু সবাইকে একপাশে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, কেউ একজন একটা ইট নিয়ে আয় বড় দেখে। আর রাশেদ, তুই ধর বন্দুকটা—আস্তে আস্তে নামাবি। কিন্তু খবরদার কেউ যেন ছুঁতে না পারে। আর সবাই শোন, আমি এই ইটটা লোকটার মাথায় ছেড়ে দেয়া মাত্র সবাই মিলে তারিককে ধরে হ্যাচকা টানে তুলে আনবি, আর রাশেদও বন্দুকটা টেনে নিবি। খবরদার তারিক আর বন্দুক দুইটাই যেন আসে।
অন্য সময় কখনও ওরা এ ধরনের ব্যাপারে রাজি হতো না। কিন্তু এতক্ষণ দীপু এত সব কাজকর্ম করেছে যে সবাই দীপুর উপর পুরোপুরি বিশ্বাস এনে ফেলেছে। কেউ আর আপত্তি করল না রাজি হয়ে গেল।
তারিক নিচে থেকে বলল, তিন শো পুরা নেই। দুই শো আশি টাকা আছে।
দীপু বিরক্ত হবার ভান করে বলল, ঠিক আছে, তাই আন। কী আর করব।
নিচে থেকে লোকটা বলল, বন্দুকটা নামাও।
রাশেদ সাবধানে বন্দুকের নলটা একটু নামাল, অমনি নিচে থেকে লোকটা চিৎকার করে উঠল, ওকি? গুলি করবে নাকি? উলটো করে নামাও।
দীপু হাতে বড়সড় একটা ইট নিয়ে জিজ্ঞেস করল, তারিক উঠছিস?
হ্যাঁ। এই উঠলাম এক পা। এই আরেক পা।
রাশেদও বন্দুকটা নামাচ্ছে আস্তে আস্তে। তারিককে এখনও দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু উত্তেজনায় সবার বুক ধক ধক করছে, শেষ পর্যন্ত সব ঠিক ঠিক হয়ে যাবে তো?
আস্তে আস্তে তারিকের মাথা দেখা গেল। বাবু ঠোটে আঙুল দিয়ে ওকে চুপ করে থাকতে বলল, তারিক বুঝে গেল কী হচ্ছে। সারা শরীর ওর টান টান হয়ে গেল সাথে সাথে। চোখ টিপে বলল, আমার পা ধরে রেখেছে, বন্দুকটা ছেড়ে দে এবারে।
দিচ্ছি—বলে, দীপু আন্দাজ করে ইটটা ছেড়ে দিল।
নিচে থেকে একটা প্রচন্ড চিৎকার শোনার সাথে সাথে রাশেদ বন্দুকটা আর অন্য সবাই তারিককে হ্যাচকা টান মেরে উপরে তুলে আনল।
দীপু চিৎকার করে বলল, খবরদার কেউ যদি বের হতে চেষ্টা কর গুলি করে ঘিলু বের করে ফেলব।
নিচে থেকে গোঙানোর মতো একটা শব্দ শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু কেউ বের হবার চেষ্টা করল না। তারিকের পেটের ছাল ঘষা খেয়ে খানিকটা উঠে গেছে। কিন্তু সেরকম কিছু না, সে দীপুর পাশে বসে পড়ল, সাবধান দীপু, সাহেব কিন্তু সাংঘাতিক—ভয় লাগে দেখলে। তোরা সবাই হাতে ইট নিয়ে দাঁড়া, কেউ বের হতে চাইলেই–
নিচে থেকে সাহেবের প্রচন্ড চিৎকার শোনা গেল। রেগে কী যেন বলছে। হঠাৎ দুটি গুলির শব্দ বের হল ভেতর থেকে ছিটকে সরে গেল দূরে সবাই। নান্টু আবার কান্না কান্না হয়ে যাচ্ছিল, তারিকের ধমক খেয়ে সামলে নিল তাড়াতাড়ি। সবাই বেশ কয়টা করে ঢিল কুড়িয়ে নিয়ে তৈরি রাখল হাতের কাছে।
দীপু যদিও ভয় দেখাচ্ছিল, যে, কেউ বের হতে চেষ্টা করলেই গুলি করে খুলি ফুটো করে দেবে কিন্তু ও খুব ভাল করে জানে যে কেউ যদি সত্যি বের হয়ে আসত ও কখনও গুলি করতে পারত না। ঢিল জমা করে তৈরি হবার পর ও অনেকটা নিশ্চিত হতে পারল, গুলি করার থেকে ঢিল মারা অনেক সোজা।
তারিক ফিসফিক করে বলল, পুলিশকে খবর দিতে পাঠাবি না? আমি যাব?
ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলল তারিককে, আস্তে আস্তে বলল, পাঠিয়েছি, এদের শুনিয়ে কাজ নেই, তা হলে বের হবার জন্যে অস্থির হয়ে পড়বে।
তারিক একগাল হেসে তার পেটের ছাল ওঠা জায়গাটায় হাত বোলাল, বিড়বিড় করে বলল, ছাল উঠে গেছে শালার।
ফেঁসে যে যাসনি–
ঠিক বলেছিস। শালার যা ভয় পেয়েছিলাম। বাসায় গিয়েই ফকিরকে পয়সা দেব।
হঠাৎ করে ফুটো থেকে একটা মাথা অল্প একটু বের হল, অন্ধকারে বোঝা যায় দেশী না বিদেশী, কিন্তু কেউ একজন যে বের হতে চেষ্টা করছে তাতে সন্দেহ নেই।
মার মার করে দশজনের অন্তত দু’শো ইট ছুটে গেল, আর লোকটা চিৎকার করে ভেতরে ঢুকে গেল। চিৎকার শুনে বোঝা গেল বিদেশিটা শেষ চেষ্টা করেছে।
দীপু চিৎকার করে বলল, কেউ বের হতে চেষ্টা করলেই এই অবস্থা হবে। মিঠু সেটা ইংরেজিতে অনুবাদ করে বলল, ট্রাই এগেন এন্ড উই উইল ব্রেক ইওর হেড উইথ ঢেলা।
রাইট। সবাই খুশিতে চিৎকার করে উঠল, ব্রেক দ্যা হেড, ব্রেক দ্যা হেড, ব্রেক দ্যা হেড।