নিচে খুব উত্তেজিত কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ওরা কিছু বুঝতে পারছিল না। তারিকও কিছু বলছে না, কী হচ্ছে না হচ্ছে কে জানে। দীপুর গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল ভয়ে।
নিচের হৈচৈ হঠাৎ থেমে গেল। পরিষ্কার বাংলায় একজন কথা বলে উঠল, উপরে যারা আছো শোনো। এই সাহেব খুব খেপে গেছে, দশ পর্যন্ত গোনার আগে বন্দুকটা নিচে ফেলে দাও, নইলে তোমাদের এই বন্ধুটিকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে।
মুহূর্তে সবার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। দীপু কিছু চিন্তা করতে পারছিল না, সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। শুধু মনে হচ্ছিল ওর জন্যেই বুঝি তারিক মারা পড়তে যাচ্ছে। নিজেকে নিজে বোঝাল, মাথা ঠান্ডা রাখো, মাথা ঠান্ডা রাখো।
ওয়ান–
নিচে থেকে সাহেবের ভারী গলা শুনে ওপরের ওরা সবাই চমকে উঠল। বাবু। ভাঙা গলায় বলল, দীপু বন্দুকটা ফেলে দে। তাড়াতাড়ি।
টু—
তাড়াতাড়ি ফেল দীপু-বাবু এবারে একেবারে কেঁদে দিল।
দীপু তাড়াতাড়ি চিন্তা করার চেষ্টা করল, বন্দুকটা ফেলে দিলেই ওদের সব ক্ষমতা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু দশ পর্যন্ত গোনার আগেই বন্দুকটা ফেলে দিতেই হবে। হয়তো তারিককে মারবে না, শুধু ভয় দেখাচ্ছে, কিন্তু জানের ঝুঁকি কখনও নেয়া যাবে না।
তবু একটা চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?
থ্রী!
দীপু গলা পরিষ্কার কর বলল, শোনো! তোমরা আসলে আমাদের ভয় দেখাচ্ছ। তারিককে মারলে পালাতে পারবে কোনোদিন এখান থেকে? পুলিশ এসে কাঁক করে ধরবে, তারপর একেবারে ফাঁসি।
সাহেবটি ইংরেজিতে কী বলল, বোধকরি জানতে চাইল দীপু কী বলছে। সাথের লোকটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিতেই সাহেবটি আবার রেগেমেগে কি যেন বলল। লোকটি তখন বাংলায় বলল, সাহেব জিজ্ঞেস করছে, তোমরা কি দেখতে চাও খামোকা ভয় দেখাচ্ছে না সত্যি বলছে?
দীপু তাড়াতাড়ি বলল, না।
তা হলে বন্দুকটা ফেলে দাও।
ফেলছি, তার আগে আমাদের কথা শোনো।
কোনো কথা শুনব না, বন্দুকটা ফেলো।
শুনতে হবে।
শুনতে হবে, শুনতে হবে, শুনতে হবে, দীপু চিৎকার করে বলল, শুনতে হবে, এছাড়া বন্দুক ফেলব না।
নিচে থেকে লোকটি বলল, কী বলবে?
তোমরা জান তোমরা আটকা পড়ে গেছ। তোমরা এও জান যে তোমাদের। বের হবার আর কোনো রাস্তা নেই। তারিককে যদি মেরে ফেল আমরা কোনোদিন তোমাদের ছাড়ব না, পুলিশ ডেকে আনতে মোটে ঘন্টাখানেক লাগবে, তারপর সবার ফাঁসি হয়ে যাবে। তবে মুশকিল হল কী জান? তোমরা বুঝে গেছ তারিককে মেরে ফেলার ভয় দেখালে আমরা তোমাদের ছেড়ে দেবই, বন্ধুর জান নিয়ে তো আর খেলতে পারি না–
সাহেবটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে দেয়া পর্যন্ত দীপুর থামতে হল। সাহেবটি গর গর করে বলল, ও ভয়টয় দেখাচ্ছে না, একটু দেরি হলে ও সত্যি গুলি করে দেবে।
দীপু বলল, শুধু শুধু ভয় দেখাচ্ছ তোমরা। আসলে কোনোদিনও তোমরা গুলি করবে না, গুলি করলে উলটো তোমাদেরই ফাঁসি হয়ে যাবে। কিন্তু যদি আমাদের কথা শোন আমরা তোমাদের চলে যেতে দেব।
কী কথা?
শুনবে তা হলে?
বলো আগে।
দীপুর মুখে একগাল হাসি খেলে গেল। ওদের আটকে রাখার জন্যে এখন একটা বিশ্বাসযোগ্য গল্প বের করতে হবে। যদি সে বলে তারিককে ছেড়ে দিলে ওরা বন্দুক দিয়ে দেবে, তা হলে এরা রাজি হয়ে যাবে, কিন্তু ওদের বিশ্বাস নাও করতে পারে। বলবে ঠিক আছে বন্দুকটা আগে দাও! এমন একটা কিছু বলতে হবে যেন বিশ্বাস করে। কি বলতে পারে? কী? কী?
ঠিক তক্ষুনি ওর মাথায় বিদ্যুতের মতো খেলে গেল—টাকা, টাকা চাইতে হবে।
আমাদের দশ হাজার টাকা দাও, ছেড়ে দেব।
কী? দশ হাজার টাকা! লোকটা হাসির মতো শব্দ করল।
দীপুর নিজেরই একটু লজ্জা লাগছিল বলতে, কিন্তু ও জানে শুধু টাকার কথা বলেই ওদের আটকে রাখা যাবে। পৃথিবীতে অনেক মানুষই টাকাকে খুব ভাল করে চেনে।
ঠিক আছে, দীপু বলল, দশ হাজার দিতে না চাও পাঁচ হাজার দাও। তোমরা তো বিদেশে এই মূর্তি বিক্রি করে লাখ টাকা পাবে, আমাদের পাঁচ হাজার দাও।
ফাজলামি পেয়েছ? এক্ষুণি বন্দুকটা ফেলে দাও, না হয় সাহেব গুলি করে দেবে।
দীপু একটু আহত স্বরে বলল, তুমি একটু বলেই দ্যাখো না সাহেবকে সাহেব কী বলে।
অনেকক্ষণ কথা হল সাহেবের সাথে লোকটার। দীপুর একটু আশা হচ্ছিল। হয়তো তাদের বিশ্বাস করতেও পারে। সত্যি সত্যি ওদের বিশ্বাস করল, ভাবল সত্যিই টাকা পেলেই বুঝি ছেড়ে দেবে! লোকটা বলল, সহেব রাজি হয়েছে একশো। টাকা দেবে বলেছে।
দীপু হাসি আটকে রেখে বলল, একশো টাকা! এটা কি চিংড়ি মাছের বাজার, যে দরদাম করছ? পাঁচ হাজার টাকার এক পয়সা কম না।
দীপু বুঝতে পারছিল না কতক্ষণ সে এইভাবে দরদাম করে যাবে। বিরক্ত হয়ে যদি গুলি করে বসে? পুলিশ আসতে আর কত দেরি কে জানে।
দীপু খুব ঠান্ডা মাথায় আবার কথা শুরু করল, দেখ, একটু পরেই সূর্য উঠে যাবে, তখন তোমাদেরই পালাতে অসুবিধা হবে। রাজি হয়ে যাও, তোমাদের ভাল, আমাদেরও ভাল। আমরা কাউকে বলব না পর্যন্ত।
আমাদের কাছে এত টাকা নেই।
কত আছে?
দু-তিন শো।
আর কিছু নেই?
না।
ঘড়ি, ক্যামেরা? দীপুর নিজের উপরে ঘেন্না হচ্ছিল এভাবে কথা বলতে, কিন্তু না বলে করবে কী, ওদের বোঝাতেই হবে টাকা পেলেই ওরা খুশি!
না, আর কিছু নেই।
কী বলছ! নিশ্চয়ই সাহেবের হাতে ঘড়ি আছে।
দেয়া যাবে না। দিয়ে দাও না, সাহেব আরেকটা কিনে নেবে!