দীপু তার সাদা শার্টটা পালটে নান্টুর গায়ের সবুজ রঙের শার্টটা পরে নিল, তা হলে দূর থেকে দেখা যাবে না। রওনা দেবার আগে বলল, আমার আসতে একটু দেরি হতে পারে, কেউ ভয় পাস নে।
সাজ্জাদ বলল, দাঁড়া একটু—দীপু দাঁড়াল। সাজ্জাদ তিনবার কুলহু আল্লাহ পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে দিল, যা, কোনো ভয় নেই!
বরাবরই সাজ্জাদ ধার্মিক ছেলে, দীপু একটু হাসল খুশি হয়ে, তারপর রওনা দিল। জঙ্গলের অনেক ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল, হাতড়ে হাতড়ে কালাচিতার কাছে আসতেই ওর অনেক সময় লেগে গেল। ওর তারিকের মতো সাপ নিয়ে বাড়াবাড়ি ভয় নেই। তবুও জেনেশুনে একটা সাপের ঘাড়ে পা দিতে চায় না। শীতকালে নাকি সাপ বের হয় না। দীপু সেটা জানে, কিন্তু কথা হল সাপেরা জানে তো যে শীতকালে বের হতে হয় না?
অন্ধকারে থেকে থেকে চোখ এখন সয়ে গেছে। কালাচিতার কাছাকাছি এসেও জায়গাটা ভাল করে দেখার চেষ্টা করল। ডান পাশ দিয়ে গেলে একটা ঢালুমতো জায়গা পাওয়া যায়, কাটা গাছ আর জঙ্গলে ভরা, তবে সেটা কালাচিতার খুব কাছে। তারিক আর সে ঠিক করেছিল কিছু ইট সরিয়ে এদিকে একটা দরজা তৈরি করবে। ওখানে হাজির হতে পারলে ভেতরে কী হচ্ছে শোনা যেতে পারে। দীপু কীভাবে যাবে ঠিক করে নিল। সোজা সামনের ঝোঁপটার দিকে গিয়ে ডান দিকে বেঁকে যাবে। বাইরে কেউ পাহাড়া দিচ্ছে নিশ্চয়ই, কিন্তু দীপু খুঁজে পেল না।
দীপুর প্রায় হার্টফেল করার মতো অবস্থা হল যখন সে আবিষ্কার করল যে সে যে-ঝোঁপটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেটি একটি মানুষ, মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে আছে। ঘাড়ে বন্দুক না লাঠি সে বুঝতে পারল না! একটুও শব্দ না করে ও আস্তে আস্তে পিছিয়ে আসতে থাকে। ভাগ্যিস ঠিক তক্ষুণি লোকটি একটি সিগারেট ধরিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে থাকে। ম্যাচ জুলতেই ও লোকটিকে দেখতে পেল, কালো এবং শুকনো। ঘাড়ে যে জিনিসটি সেটি বন্দুক তাও স্পষ্ট দেখতে পেল।
পিছিয়ে এসে সে অন্যদিকে দিয়ে ঢালটার কাছে হাজির হল। কান লাগিয়েও সে কিছু শুনতে পেল না, একটু টুকটাক শব্দ হচ্ছে, কিন্তু কিসের জন্যে? হঠাৎ ভেতরে কে কথা বলে উঠল, বল আর কে আছে তোর সাথে?
দীপু তারিকের গলার স্বর শুনতে পেল, আর কেউ নাই।
তোর সাথে যে আরেকটা ছেলে থাকে, ও কোথায়?
দীপু বুঝতে পারল তার কথা বলছে।
অনেকক্ষণ কোনো কথা শোনা গেল না, তারপর ভারী গলার একজন কী বলে উঠল। কথা শুনে মনে হয় বিদেশী। দীপু বেশি অবাক হল না, বিদেশীরা নাকি এসব চুরি করে বেড়াচ্ছে। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সব জিনিস নাকি চুরি করা :
দীপু কান পেতে কতজন লোক, কী করছে শোনার চেষ্টা করল। কমপক্ষে চারজন লোক আছে ভেতরে। ওরা আর বেশিক্ষণ থাকবে না, কী-একটা খুঁড়ে বের করছে। ওটা করা মাত্রই প্যাকেট করে পালাবে। দীপু তারিকের সাথে থাকতে পারে তা-ই সন্দেহ করে এই তাড়াহুড়া। দীপু বুঝতে পারল, তাড়াতাড়ি ওদের কিছু করতে হবে, ওরা পালানোর আগে। তারিক ভাল আছে, কিছু হয়নি এটা চিন্তা করেই তার বুকের বোঝাটা চলে গেছে।
যত সাবধানে দীপু এসেছিল তার থেকে অনেক বেশি সাবধানে দীপু ফিরে এল। সবাই ওর জন্যে অস্থির হয়ে বসেছিল, দেরি দেখে অনেকে সন্দেহ করছিল হয়তো ও ধরা পড়ে গেছে। ফিরে আসতে দেখে ওদের খুশির সীমা থাকল না। তারিকের কিছু হয়নি শুনে উৎসাহ দশগুণ বেড়ে গেল সবার। দীপু খুব তাড়াতাড়ি অল্প কথায় সব বুঝিয়ে দিল। ওরা বেশিক্ষণ থাকবে না, যা-ই করতে হয় খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। একবার চলে গেলে আর ধরা যাবে না।
সাজ্জাদ বলল, কাউকে গিয়ে থানায় খবর দিয়ে আসতে হবে।
হ্যাঁ, কিন্তু থানা কতদূর জানিস? গিয়ে ফিরে আসতে আসতে ওরা সবাই হাওয়া হয়ে যাবে।
তা হলে?
দীপু সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, একটা খুব ভাল উপায় আছে।
কী?
বাইরে যে লোকটা পাহারা দিচ্ছে ওকে ধরে ওর বন্দুকটা কেড়ে নিই, তা হলে সবাইকে ভেতরে আটকে ফেলা যাবে। কালাচিতা থেকে বের হবার রাস্তা মোটে একটা, ওখানে বন্দুক হাতে নিয়ে বসে থাকলে কেউ বের হতে পারবে না।
দীপুর কথা শুনে কারও কারও হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। বাবু দুর্বল গলায় বলল, যদি গুলি করে দেয়?
ওকে গুলি করার সুযোগ কে দেবে? আমরা পেছন থেকে একসাথে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। প্রথমেই বন্দুকটা কেড়ে নিতে হবে। তারপর ওকে বেঁধে ফেলতে কতক্ষণ!
যদি দেখে ফেলে।
সেটুকু রিস্ক তত নিতেই হবে, চেষ্টা করা হবে যেন না দেখে। সবাই খুব আস্তে আস্তে লোকটার কাছাকাছি চলে যাবে। তারপর যেই মিঠু শেয়ালের ডাক দেবে তক্ষুণি মনে মনে এক দুই তিন গুনে একসাথে লাফ দিতে হবে।
ঠিক। মিঠুর বুদ্ধিটা খুব পছন্দ হয়ে যায়। আমি সামনের দিকে থাকব, শেয়ালের ডাক শুনেই লোকটা একটু চমকে উঠে আমার দিকে তাকাবে, আর অমনিই সবাই একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়বি।
হ্যাঁ, দীপু আরও ছোটখাট ব্যাপার ঠিক করে নেয়, বন্দুকটা খুব সাবধানে, নলটা সবসময় উপরে দিকে রাখতে হবে যেন গুলি বেরিয়ে গেলেও কারও ক্ষতি
হয়। আর সবচেয়ে যেটা জরুরি সেটা হচ্ছে মিঠুর শেয়ালের ডাকের পর মনে মনে এক দুই তিন গুনে সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সবাইকে। কারও যদি ভয় থাকে আগেই বলে দে। আছে কারও?
না।
গুড, কেউ যদি ঠিক সেই সময়ে ঝাঁপিয়ে না পড়িস তা হলে কিন্তু কী হবে কিছু বলা যাবে না।