তাই? দীপু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, কী পাজি সাপুড়েরা।
পাজি হবে কেন। তাবিজ বিক্রি করে সে বেচারারা তাদের ছেলেমেয়েদের খাওয়ায়। এটা তাদের ব্যবসায়। লোকজনকে বিশ্বাস না করালে তাবিজ বিক্রি করবে কেমন করে?
আর কেউ যদি ওটা বিশ্বাস করে সাপের কামড় খায়?
তা খাবে না। সাপ দেখলেই তাবিজ-টাবিজ ভুলে দৌড় দেবে।
তা হলে সাপ থেকে বাঁচার কোন জিনিস নেই?
থাকবে না কেন? কার্বলিক অ্যাসিড। আমি যখন আসামে থাকতাম সাপ কিলবিল করত। একটা বোতলে ভরে মুখ খুলে রাখতাম, সাপ ধারে কাছে আসত না।
কী নাম বললে?
কার্বলিক অ্যাসিড। খুব কড়া বিষ কিন্তু, একটু পেটে গেলে সোজা বেহেশত। তোর হঠাৎ দরকার পড়ল কেন? সাপের বিজনেস করবি নাকি?
যাও। ছি!
দীপু নিজের ঘরে গিয়ে কার্বলিক অ্যাসিড শব্দ লিখে রাখল ভুলে যাবার আগে। তারপর যত্ন করে আম্মার চিঠিটা খুলে পড়তে বসল।
.
কলাচিতায় কীভাবে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করবে দীপু আর তারিক এই নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করল। তারিককে দীপু কিছুতেই বোঝাতে পারল না সাপের তাবিজটা আসলে একটা ভাওতাবাজি। তারিক ডাক্তারের দোকানে ঘুরে ঘুরে কার্বলিক অ্যাসিড কিনে আনল ঠিকই, কিন্তু তাবিজটা ছাড়তে রাজি হল না। খোঁড়াখুঁড়ি করার জন্যে শাবল কোদাল মাটির টুকরি জোগাড় করে সাবধানে কালাচিতায় নিয়ে যাওয়া হল। দুজনে মিলে পুরো কালাচিতাটা সাবধানে ঘুরে ঘুরে একটা ম্যাপ তৈরি করল। যত্ন করে খোঁজাখুঁজি করে ওরা আরও মজার মজার জায়গা খুঁজে পেল। ছোট ছোট কুঠুরি কিছু কিছু আবার সুড়ঙ্গ দিয়ে একটার সাথে আরেকটার যোগাযোগ। কোথাও কোথাও মাটি ধসে পড়ে সব বন্ধ হয়ে আছে। সব খুঁড়ে ফেলতে পারলে কত মজার জিনিস যে বের হবে কে জানে! উত্তেজনায় ওরা টগবগ করতে থাকে।
মাটি খোঁড়াটা কিন্তু সেরকম হয়ে উঠছে না। রাতে দীপুর পক্ষে যাওয়াটা সম্ভব না। আব্বাকে সব খুলে বললে আব্বা হয়তো আপত্তি করবেন না কিন্তু এটা এখন। আব্বাকে বলা সম্ভব না। আর আব্বাকে না বলে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। এখন শুধু স্কুল ছুটির পরে যায়। বন্ধুবান্ধব সবাইকে ধোঁকা দিয়ে কালাচিতায় যাওয়া খুব কঠিন। কোনো কোনোদিন ওরা যেতে পর্যন্ত পারে না। সবার সাথে ফুটবল খেলতে হয়। কয়দিন পরে স্কুল ছুটি হয়ে যাবে, তখন সারাদিন কালাচিতায় থেকে কাজ করতে পারবে। সেই আশাতেই আছে।
এর মাঝে হঠাৎ একদিন একটা ব্যাপার হল। কালাচিতায় কাজটাজ করে দীপু বাসায় ফিরে এসে দেখে ওর আব্বার এক বন্ধু অপেক্ষা করে বসে আছেন।
হাতমুখ ধুয়ে আসার আগেই আব্বা তাকে ধরে নিয়ে গেলেন তার বন্ধুর কাছে। বললেন, জামশেদ, এই হচ্ছে আমার ছেলে দীপু। আর দীপু, এ হচ্ছে। তোর জামশেদ চাচা।
জামশেদ নামের ভদ্রলোকটির বয়স ওর আব্বার থেকে বেশি হতে পারে। কানের পাশে চুল পেকে গেছে। মোটাসোটা ভদ্রলোক। দীপু অবাক হয়ে দেখল ভদ্রলোকের হাতে তার কালাচিতাটা। ভদ্রলোকের চোখ চকচক করছিল, দীপুকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা তুমি কোথায় পেয়েছ?
আমার একজন বন্ধু আমাকে দিয়েছে।
সে এটা কোথায় পেয়েছে?
দীপু একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, সেটা আমি বলতে পারব না।
ভদ্রলোক ভারি অবাক হয়ে বললেন, কেন?
আমার বন্ধুকে আমি কথা দিয়েছি, আমি কাউকে বলব না।
ভদ্রলোকের বুঝতেই যেন খানিক সময় লাগল! খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বললেন, তুমি জান এটা কী জিনিস?
চিতাবাঘ!
এটার দাম জান?
দীপু চমকে উঠে বলল, কত?
টাকা দিয়ে এর দাম হয় না। এই এলাকায় মৌর্য সভ্যতার একটা চিহ্ন পাওয়া যাবার কথা। অনেকদিন ধরেই আমরা এটা খোঁজাখুঁজি করছি। তোমার এই চিতাবাঘটা হচ্ছে মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়ে তৈরি একটা ভাস্কর্য। কাজেই এটা যদি এই এলাকায় পাওয়া গিয়ে থাকে, তা হলে বুঝতে হবে কাছাকাছি এই সভ্যতার চিহ্ন আছে।
দীপুর দম বন্ধ হয়ে আসে উত্তেজনায়। তাদের কালাচিতাই তা হলে সেই জায়গা! কিন্তু সে তো কিছুতেই বলবে না জামশেদ সাহেবকে। তারিক খুঁজে বের করেছে জায়গাটা। তারিককে জিজ্ঞেস না করে সে কিছু বলতে পারবে না।
ভদ্রলোক খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, এবার বুঝতে পেরেছ কেন এই চিতাবাঘ কোথায় পাওয়া গেছে এটা জানতে চাইছি?
দীপু মাথা নাড়ল। তারপর বলল, কিন্তু আমি এখন সেটা বলতে পারব না।
তুমি জায়গাটা চেন?
হ্যাঁ, চিনি।
তা হলে চলো আমার সাথে, নিয়ে চলো সেখানে।
দীপু ওর আব্বার দিকে তাকাল। আব্বা অন্য দিকে তাকিয়ে আছেন, কাজেই আবার ঘুরে তাকাল জামশেদ সাহেবের দিকে। বলল, চাচা, আপনি কিছু মনে করবেন না, কিন্তু এখন আমি আপনাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারব না।
কেন? ভদ্রলোক এবারে যেন রেগে উঠলেন।
আমি আমার বন্ধুকে কথা দিয়েছি ওটা কাউকে বলব না। ওকে জিজ্ঞেস না করে আমি আপনাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারব না।
দীপু বুঝতে পারল ভদ্রলোক রেগে উঠেছেন। এখানে রেগে ওঠার কি আছে সে বুঝতে পারছিল না। জামশেদ সাহেব খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে খুব ঠান্ডা গলায় বললেন, তোমার বন্ধুর বাসা কোথায়? ওর বাসায় টেলিফোন আছে?
না, ওদের টেলিফোন নেই। বাসা অনেক দূরে, ধোপীর খালের ওধারে সুতার পাড়ায়।
ওর আব্বার নাম কী, কী করেন?
আব্বার নামটা ভুলে গেছি। কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন।