দীপু আরেকবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, সত্যি বলছি স্যার, আমি পারব না।
ঠিক আছে, যদি না পারিস এখানে দাঁড়িয়ে থাক পাঁচ মিনিট, আর তোরা সবাই চোখ বড় বড় করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাক।
বোঝাই যাচ্ছে, ছেলেগুলো এই স্যারের খুব বাধ্য। আদেশ পাওয়ামাত্র সবাই চুপচাপ চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল, দীপু যেদিকে তাকায় দেখতে পায় একজোড়া চোখ ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। পাঁচ মিনিট এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ভেবে ভয়ে ওর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। দুর্বল গলায় বলল, ঠিক আছে স্যার, আমি বলছি। সে গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করল, অ্যাঁ—আমার নাম মুহম্মদ আমিনুল আলম, আমি ক্লাস এইটে পড়ি।
ক্লাস এইটে পড়িস, সে তো সবাই জানে, না হয় এই ক্লাসে আসবি কেন? যেসব কেউ জানে না সেসব বল।
আমি এর আগে ক্লাস সেভেনে ছিলাম বগুড়া জিলা স্কুলে, ক্লাস সিক্সে ছিলাম। চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুলে, ক্লাস ফাঁইভে থাকতে পড়তাম বান্দরবান হাই স্কুল, ক্লাস ফোরে পচাগড় প্রাইমারি স্কুলে, ক্লাস থ্রীতে কিশোরীমোহন পাঠশালা, সিলেটে, তার আগে—ক্লাস টুতে ছিলাম—অ্যাঁ-অ্যাঁ—দীপু মাথা চুলকাতে থাকে মনে করার জন্যে। মনে করতে না পেরে বলল, রাঙামাটিতে, স্কুলটার নাম মনে নেই, ক্লাস ওয়ানে ছিলাম শেখঘাট জুনিয়র স্কুলে—
সবাই হা করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল! স্যারও একটু অবাক হয়ে বললেন, তুই কি বছর বছর স্কুল বদলাস নাকি?
আমার বদলাতে ভাল লাগে না, কিন্তু আমার আব্বা প্রত্যেক বছর নতুন জায়গায় যান, তাই আমারও যেতে হয়।
হুঁ। স্যার আবার গম্ভীর হয়ে বললেন, লেকচার শেষ কর। মাত্র এক মিনিট হয়েছে।
মাত্র এক মিনিট! দীপুর গলা আবার শুকিয়ে যায়। করুণ মুখে সে স্যারের দিকে তাকাল, স্যার ওকে সাহস দিলেন, চমৎকার হচ্ছিল তো! শুরু কর আবার—কী করতে ভালবাসিস, কী পড়তে ভালবাসিস, কী খেলতে ভালবাসিস, এইসব বল।
দীপু আবার শুরু করল, আমি ডিটেকটিভ বই পড়তে খুব ভালবাসি। আমি অনেকগুলো ভিকেটটিভ বই পড়েছি। তার মাঝে সবচেয়ে ভাল হচ্ছে—দীপু হঠাৎ থেমে গেল, কারণ, ঠিক বুঝতে পারল না নামটা বলা উচিত হবে কি না। একটু ভেবে বলেই ফেলল—প্রেতপুরীর অট্টহাসি? বইটা আমার কাছে আছে, কেউ পড়তে চাইলে আমি তাকে দিতে পারি।
পড়েছি! আমি পড়েছি! ক্লাসের অর্ধেকের বেশি ছেলে চেঁচিয়ে উঠল, আর সাথে সাথে দীপু বুঝতে পারল ছেলেগুলোর সাথে বন্ধুত্ব হতে ওর দেরি হবে না।
এ ছাড়াও আমি অ্যাডভেঞ্চারের বই পড়ি। যেমন–যক্ষের ধন, আবার যক্ষের ধন, তারপর টম সয়ার, হাক ফিনের দুঃসাহসিক অভিযান।
স্যার দীপুকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তোরা কে কে মার্ক টোয়েনের টম সয়ার আর হাক ফিনের বই পড়েছিস?
মাত্র দুটি হাত উঠল। স্যার বললেন, খুব ভাল বই, সবার পড়া উচিত! আছে তোর কাছে বই দুটি?
আছে স্যার।
তোর বন্ধুদের পড়তে দিস।
দেব স্যার।
হুঁ, এবারে শেষ কর তোর লেকচার।
দীপু আবার শুরু করল, গল্পের বই ছাড়া আমার খেলতে ভাল লাগে। বগুড়া জিলা স্কুলে থাকতে ক্লাস এইটকে আমরা হারিয়ে দিয়েছিলাম।
মোটাসোটা একটা ছেলে পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল, কোন জায়গায় খেল? সেন্টার ফরোয়ার্ড?
না, আমি রাইট আউট ছিলাম। সেন্টার ফরোয়ার্ড খেলি মাঝে মাঝে মাঝে মাঝে ব্যাকেও খেলি।
স্যার সাবধানে হাসি গোপন করলেন। তিনি খুব ভাল করে জানেন শুধুমাত্র নামেই সেন্টার ফরোয়ার্ড আর রাইট আউট। এই বয়েসী ছেলেদের খেলা শুরু হলে দেখা যায়, বল যেখানে, গোল কীপার ছাড়া সবাই সেখানে দাপাদাপি করছে।
এ ছাড়া ব্যাডমিন্টনও খেলি, কিন্তু কর্কের দাম এত বেশি হয়ে গেছে যে, সবসময় খেলতে পারি না। কয় মিনিট হয়েছে, স্যার?
আড়াই মিনিট।
মাত্র আড়াই মিনিট?
হুঁ, শুরু কর আবার।
সব তো বলে ফেলেছি, আর কী বলব?
কী কী করতে পারিস এইসব বল।
কিছু করতে পারি না।
কিছু পারিস না? ছবি আঁকতে? গান গাইতে? সাইকেল চালাতে? সাঁতার কাটতে? মারামারি করতে?
দীপু মাথা নেড়ে বলল, আমি সীটে বসে সাইকেল চালাতে পারি, সাঁতারও দিতে পারি, ছবি আঁকতে পারি না, ড্রয়িং পরীক্ষায় আমি সবচেয়ে কম নাম্বার পাই। আর আমি গানও গাইতে পারি না।
মারামারি? সামনের বেঞ্চের একটা ছেলে ওকে মনে করিয়ে দিল।
ও হ্যাঁ, আমি অল্প অল্প মারামারিও করতে পারি।
অল্প অল্প মারামারি আবার কী জিনিস? স্যার একটু অবাক হয়ে জানতে চাইলেন।
দীপু মাথা চুলকে বলল, মানে ঠিক-একে মারামারি না, তবে কেউ যদি আমার সাথে মারামারি করতে চায় শুধু তা হলেই একটু ইয়ে—মানে অল্প অল্প—একটু একটু–
ও! ও! বুঝেছি, তুই নিজে থেকে করিস না, তবে কেউ করতে চাইলে না করিস না, এই তো?
সারা ক্লাস হেসে উঠল এবং দীপু নিজেও হেসে ফেলল।
এখনও দেড় মিনিট বাকি। নে, শুরু কর আবার।
দীপু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাতে লাগল। আর কী সে করতে পারে মনে করার চেষ্টা করতে করতে হঠাৎ ওর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। একগাল হেসে বলল, আমি বই বাঁধাই করতে পারি, আর শর্ট সার্কিট হয়ে ফিউজ পুড়ে গেলে মেইন সুইচের ফিউজ বদলে ঠিক করে ফেলতে পারি।
কী বললি? শর্ট সার্কিট হয়ে–
হ্যাঁ, শর্ট সার্কিট হলে ফিউজ পুড়ে যায় তো, তখন মেইন সুইচ অফ করে ব্রিজটা খুলে নিয়ে একটা চিকন তার ওখানে লাগিয়ে দিলে আবার সব ঠিক হয়ে যায়।