.
প্রায় তিন মাস পার হয়ে গেছে। দীপুর তার আম্মার সাথে যখন দেখা করতে গিয়েছিল তখন জুন মাস—গরমের সময়। এখন অক্টোবর মাস, আকাশে সাদা সাদা মেঘ ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ হঠাৎ ঠাণ্ডা বাতাসে বোঝা যায় শীত আসছে।
দীপুর মা যে এখনও বেঁচে আছেন সেটি দীপু এখনও কাউকে বলেনি। অনেক চিন্তা করে দেখেছে, না বলাই ভাল। সবাইকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে বলতে ও বিরক্ত হয়ে উঠত। শুধু তাই নয়, বুঝিয়ে দেবার সময় সবাই এমন করে ওর দিকে তাকাত যে সেটা ওর মোটেই ভাল লাগত না। দীপু আব্বার সাথে আলাপ করে দেখেছে আব্বাও বলেছেন তিনি যদি দীপুর জায়গায় হতেন তা হলে তিনিও হয়তো কাউকে বলতেন না।
দীপু কাউকেই বলেনি, কথাটি অবশ্যি পুরোপুরি সত্যি নয়। সে একজনকে বলেছে, তারিককে। তারিককে না বলে সে পারেনি, তার কারণও ছিল।
একদিন ওর তারিকের বাসায় যাবার দরকার হল। পরদিন ক্লাস নাইনের সাথে ফুটবল খেলা, তারিককে আগে থেকে বলে না দিলে ও হয়তো আসবেই না। আর তারিক যেরকম স্কুল ফাঁকি দেয়, এমনও হতে পারে যে স্কুলেই আসবে না সামনের তিন চার দিন। কিন্তু মুশকিল হল যে, দীপু তারিকের বাসা চেনে না। বেশ ক’জনকে জিজ্ঞেস করে দেখল যে কেউই চেনে না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, কেউ বলতে পর্যন্ত পারল না ও কোন এলাকায় থাকে। সতু শুধু বলল, হতে পারে ও খালের ওপারে থাকে, কাঠের পুলের ওপর দিয়ে ও কয়দিন তারিককে বইখাতা নিয়ে আসতে দেখেছে।
বাসা খুঁজে বের করতে দীপুর কেমন জানি একটু মজা লাগে। এবারে কোনোকিছু না জেনেও সে আগে বাসা খুঁজে বের করেছে। খুঁজে বের করা যত কঠিন হয়ে ওঠে, তত মজা লাগতে থাকে। অবশ্যি একা একা একটু বিরক্তিকর হয়ে ওঠে, সাথে কেউ থাকলে খুব ভাল।
আজ ওর একাই বের হতে হল। সবই কোনে-না-কোনো কাজে ব্যস্ত। এত যে নিমর্মা বাবু, তারও নাকি আজ খালার বাসায় বাগানের সবজি নিয়ে যেতে হবে!
ধোপীর খাল অনেক দূর, তিন মাইলের কম কিছুতেই না। খালের উপরে কাঠের পুল, তার সামনে একটা ছোট দোকান। দীপু সেখানে খোঁজ নিল, ছেলেটি তারিকের নাম জানে না, কিন্তু চিনতে পারল। বলল, এদিকেই কোথায় যেন থাকে। পুলটা পার হয়ে ও আরও কয়েকটা পানের দোকানে খোঁজ নিল, তাদের মাঝে একজন তারিককে চিনতে পারল, এমনকি তারিকের আব্বার নাম পর্যন্ত বলে দিল। ওরা সুতারপাড়ায় থাকে, ওর আব্বা একজন কাঠমিস্ত্রি।
এরপরে দীপুর কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবার কথা, পাড়াটার নাম জানে, তারিকের নাম পর্যন্ত জানে। কিন্তু মজার ব্যাপার, ও কিছুতেই তবু বাসাটা খুঁজে পেল না। ছোট ছোট গলি দিয়ে ও ঘুরে বেড়াতে লাগল। ঘিঞ্জি ঘিঞ্জি পাশাপাশি বাড়ি, নোংরা নর্দমা, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে খালি গায়ে ছোটাছুটি করছে। এর মাঝে কোনটা তারিকের বাসা কে জানে!
দীপু তখন ছোট ছোট ছেলেদের জিজ্ঞেস করতে লাগল, ওরা অনেক সময়। বেশি খবর রাখে। প্রায় দশজনকে জিজ্ঞেস করে ও প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিল, তখন একজন তারিককে চিনতে পারল। বলল, ও, কাচু ভাই? ফাগলি বাড়ির।
কাচু ভাই মানে?
তারিক তো হের স্কুলের নাম। বড়িতে হেরে কাচু ভাহে। আহ আমার লগে, ফাগলি বাড়িত থাকে।
দীপু ওর কথা ভাল বুঝতে পারছিল না, পিছে পিছে গেল তবু। ছেলেটি বাঁশের দরমার নড়বড়ে একটা বাসায় সামনে দাঁড়িয়ে বলল, এই বাড়ি। ফাগলি থাহে এই বাড়িত। ছেলেটা একগাল হেসে চলে গেল।
দীপু ডাকল, তারিক, এই তারিক।
অমনি এক ভীষণ ব্যাপার ঘটে গেল। ভেতর থেকে মেয়েলি গলার একটা ভীষণ চিৎকার শোনা গেল। তারপর হঠাৎ দরজা খুলে গেল আর ময়লা ছেঁড়া কাপড় পরা একজন পাগলি বেরিয়ে এল। লাল লম্বা চুল এলোমেলো, হাত পিছনে শক্ত করে বাঁধা, কপালে কাটা, রক্ত পড়ছে দরদর করে।
দীপু ভয় পেয়ে পিছিয়ে এল। দৌড় দেবে কি না বুঝতে পারছিল না, ঠিক এই সময়ে তারিক বেরিয়ে এল। সামনে দীপুকে দেখে মুহূর্তে ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে গেল। দুই হাতে পাগলিকে ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। ভেতরে চেঁচামেচি গালিগালাজ শোনা গেল কিছুক্ষণ, একটু পরে সব থেমে গেল, আর দরজা খুলে তারিক বের হয়ে এল। সারা মুখ থমথম করছে রাগে। দীপুর কাছে এসে রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞেস করল, এখানে এসেছিস কেন?
দীপু উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ও কে?
তোর বাপের কি তাতে?
বল না, কে?
কেউ না।
বল না!
বললাম তো, কেউ না, পাগলি।
তোর মা?
তারিক এক মুহূর্ত ওর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, হ্যাঁ। কেন জানি হঠাৎ তারিকের মুখ কান্না-কান্না হয়ে গেল, আস্তে আস্তে বলল, তুই এখন স্কুলে গিয়ে সবাইকে বলে দিবি আমার মা পাগলি?
শুনে দীপুর এত মন-খারাপ হল যে বলার নয়। তারিকের হাত ধরে বলল, তুই আমাকে তাই ভাবিস?
তারিক মাথা নেড়ে বলল, না।
হ্যাঁ, তুই যদি না চাস আমি তা হলে কাউকে বলব না, কোনোদিন বলব না।
খোদার কসম?
খোদার কসম।
ওরা দু’জন হেঁটে হেঁটে খালের ধারে একটা হিজল গাছের ডালে গিয়ে বসল। তারিক তখন দীপুকে ওর মায়ের কথা খুলে বলল। বছর চারেক আগে টাইফয়েড হয়ে ওর মায়ের মাথায় গোলমাল হয়েছে। দিনে দিনে অবস্থা আরও বেশি খারাপ হচ্ছে। এখন প্রায় সবসময়েই বেঁধে রাখতে হয়। ওদের পয়সা নেই বলে চিকিৎসা পর্যন্ত করাতে পারছে না, ঝাড়ফুক আর তাবিজের উপর চলছে। ওর বাবা বেশি খেয়ালও করেন না, মেজাজ খারাপ হলে মারধোর পর্যন্ত করেন। তারিকের যখন অনেক পয়সা হবে তখন সে তার মা’কে ভাল করিয়ে আনবে বিদেশ থেকে। ওর মা নাকি খুব আদর করতেন তারিককে, ওর মা ভাল হয়ে থাকলে ও কখনও গুন্ডা হয়ে যেত না।