দীপু ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, নান্টু কী হয়েছে?
নান্টু কোনো উত্তর দিল না।
নান্টু, নান্টু, এই নান্টু। কোনো উত্তর নেই নান্টুর। দীপু ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে আসে অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না, কাছে এসে হাত দিয়ে ওর পা ধরে নাড়া দিল দীপু।
একটা অদ্ভুত শব্দ করল নান্টু। দীপু অবাক হয়ে দেখল নান্টু থরথর করে কাঁপছে। ভয়ে দীপুর শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল মুহূর্তে।
উপর থেকে তারিকের হাসি ভেসে আসে, কী রে মুরগির বাচ্চারা, উঠিস না কেন? বার্লি খাবি?
দীপু আবার নান্টুকে ডাকল, নান্টু দাঁড়িয়ে থাকিস না, ওপরে ওঠ।
নান্টু কোনো উত্তর দিল না, গোঁ-গোঁ করে একটা শব্দ করল।
ওঠ। ওঠ বলছি!
ভাঙা গলায় নান্টু বলল, পারব না।
পারবি না মানে?
নান্টু গোঙাতে গোঙাতে বলল, পারব না, পারব না।
আর অল্প বাকি, উঠে পড়।
পারব না, পারব না, পারব না—
নেমে আয় তা হলে।
পারব না, আমি পারব না।
পারবি না মানে?
উঁহু, আমি কিছু পারব না।
উপর থেকে তারিক একটু অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে, তোরা ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
দীপু বলল, নান্টু বলছে উপরে উঠতে পারবে না।
তা হলে নেমে যায় না কেন?
নামতেও পারছে না।
মানে?
ঠিক তক্ষুণি নান্টু হঠাৎ কাঁদতে শুরু করল।
অন্ধকারে, প্রায় দুশো ফিট উপরে সরু লোহার খাড়া সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেউ যদি কাঁদতে শুরু করে, তখন অবস্থাটা কল্পনা করা যায় না। তারিক ভয় পেয়ে বলল, এই দীপু, কাঁদছে কেন নান্টু?
জানি না।
উপরে তুলে আন ওটাকে।
আমি কীভাবে তুলব?
দাঁড়া, আমি টেনে তুলছি?
উপর থেকে তারিক নান্টুর শার্টের কলার ধরে টানতে লাগল আর নিচে থেকে দীপু লোহার মতো হয়ে অ্যাঁকড়ে থাকা নান্টুর হাত খুলে উপরে ধরিয়ে দিতে লাগল, তারপর সাবাধানে পা ঠেলে ঠেলে উপরের সিঁড়িতে তুলে দিল। মুখে ক্রমাগত ধমক আর অনুরোধ করে যেতে লাগল। তিনটি ধাপ ওকে তুলে আনতে অন্তত দশ মিনিট সময় লেগে গেল।
উপরে উঠে নান্টু মুখ চেপে শুয়ে পড়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে কাঁদতে লাগল। দীপুর মনে হল বুঝি মরেই যাবে।
তারিক ভারি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ওরকম করছে কেন?
বোধ হয় ভয় পেয়েছে।
ভয় পেয়েছে তো উঠেছে কেন?
আমি কী জানি।
যত্তসব ফাজলেমি! মুরগির বাচ্চার মতো ভয়, তা হলে উঠতে যায় কেন?
আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন?
ওকেই জিজ্ঞেস কর।
দীপু খুব ঘাবড়ে গেল। নিচে থেকে অন্যরা বুঝতে পেরেছিল একটা কিছু গোলমাল হয়েছে। বাবু চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে দীপু?
দীপু কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না। সন্ধ্যার সময় কয়টি ছেলে পানির ট্যাংকের নিচে দাঁড়িয়ে আছে আবার কয়টি ছেলে এত উঁটু ট্যাংকের উপরে উঠে গেছে, আশেপাশে এমনিতেই লোকজনের ভিড় জমে যাবার কথা। দীপুর সব মিলিয়ে খুব অস্বস্তি লাগতে থাকে। তাকিয়ে দেখল, সত্যি সত্যি নিচে লোকজনের ভিড় জমে গেছে। কেউ যে ব্যাপারটি ভাল চোখে দেখছে না তা আর বলতে হল না। আরও বেশি লোক জমে যাবার আগেই একটা-কিছু করা দরকার। সে চেঁচিয়ে বলল, তোরা বাসায় চলে যা।
কেন?
যা বলছি, এখানে দাঁড়িয়ে থাকিস না। খবরদার!
যেসব লোক এর মাঝে জমা হয়ে গিয়েছিল তারা জানতে চেষ্টা করল ব্যাপারটি কী। কিন্তু নিচে যারা আছে, তারা ব্যাপারটি আসলেই জানে না, অন্যদের কী বলবে! দীপুর কথামতো তারা সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করল। কৌতূহলী লোকজন খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে চলে গেল।
শেষ লোকটি চলে যাবার পর তারিক বলল, আমি গেলাম।
মানে?
মানে আবার কী? সারারাত বসে থাকব নাকি?
সত্যি সত্যি তারিক উঠে দাঁড়িয়ে নামার আয়োজন করতে থাকে। দীপু নান্টুকে ডাকল, নান্টু কোনোমতে উঠে বসে থরথর করে কাঁপতে লাগল। ওকে নামার কথা বলার কোনো অর্থ হয় না, এখানে বসে থেকেই সে একটা অস্বাভাবিক ভয়ে কাঁপছে। কিছু-একটা হয়ে গেছে ওর।
দীপু তবু চেষ্টা করে দেখল, নান্টু, নামবি না?
নান্টু জবাব দিল না। আগের মতো কাঁদতে লাগল।
বসে থাকবি নাকি সারা রাত?
নান্টু তবু জবাব দিল না, কাদাটা একটু বেড়ে গেল শুধু।
আমরা গেলাম তা হলে।
নান্টু একটু জোরে কেঁদে উঠল এবার।
তারিক বিরক্ত হয়ে বলল, আমি জানি না বাপু, তোর যা ইচ্ছে হয় কর। আমি যাচ্ছি।
এই তারিকের জন্যই যত গন্ডগোল, দীপু তারিকের উপর রেগে উঠল। কিন্তু রেগে তো আর সমস্যার সমাধান হয় না। সত্যি সত্যি যদি নান্টু নামার সাহস না পায় তা হলে অবস্থাটা কী হবে ভাবতে পারে না।
তারিককে খুব বেশি চিন্তিত মনে হল না। সে দীপুর উপর সমস্ত দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে নেমে গেল। উপর থেকে দেখল, তারিক শিস দিতে দিতে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে রাস্তা ধরে।
দীপু একা একা বসে রইল নান্টুকে নিয়ে। অনেক বুঝিয়ে ধমক দিয়ে বা ভয় দেখিয়েও কোনো লাভ হল না। নান্টু ঐভাবে বসে কেঁদে যেতে লাগল। দীপু বুঝতে পারছিল, ও ঠিক স্বাভাবিক নেই, হঠাৎ খুব বেশি ভয় পেয়ে একটা কিছু ঘটে গেছে ওর ভেতর। কিন্তু বুঝেই-বা লাভ কী। আরও কিছুক্ষণের ভেতর নিশ্চয়ই খোঁজাখুঁজি শুরু হবে। তখন কী হবে সে ভেবে পায় না। এক হতে পারে সে নিজে নেমে গিয়ে নান্টুর বাসায় খবর দিয়ে পালিয়ে যায়, তারপর নান্টুর বাসার লোজকন যা ইচ্ছে হয় করুক! কিন্তু পর মুহূর্তে সে এটা উড়িয়ে দেয়। পুরো ঘটানার দায়িতু ওকেও নিতে হবে। আব্বাকে জানালে আব্বা নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করবেন, কিন্তু তার আগে তার গলায় দড়ি দিয়ে মরতে হবে। ওর আব্বা ওকে যত স্বাধীনতা দিয়েছেন তত স্বাধীনতা আর কাউকে কারো আব্বা দেননি। স্বাধীনতা পেয়ে যা ইচ্ছে করে ঝামেলা বাধিয়ে আব্বার কাছে হাজির হওয়ার থেকে লজ্জার কী আছে? আব্বা হয়তো কিছু বলবেন না—হয়তো ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকাবেন, দীপু বুঝতে পারে ও তার আব্বার সামনে লজ্জায় মরে যাবে তা হলে। তার ইচ্ছে হল বসে বসে খানিকক্ষণ কেঁদে নেয়।