- বইয়ের নামঃ দীপু নাম্বার টু
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে দীপু
সময় সংস্করণের ভূমিকা
আমি যখন পদার্থ বিজ্ঞানে পি.এইচ.ডি. করার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছি তখন সেখানে আমি একেবারেই একা, বাংলায় কথা বলার একজন মানুষও নেই। পড়াশোনার প্রচণ্ড চাপ, সিয়াটলের মেঘে ঢাকা ধূসর আকাশ, গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টি, কনকনে শীত সব মিলিয়ে খুব মন খারাপ করা নিঃসঙ্গ একটা পরিবেশ। একাকীত্ব দূর করার জন্যে আমি তখন কল্পনায় একটা কিশোর তৈরি করে নিয়েছিলাম। তার নাম দিয়েছিলাম দীপু। যখন মন খারাপ হতো সেই কিশোরটি তখন আমাকে সঙ্গ দিতো, বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃষ্টিভেজা ক্যাম্পাসে পিঠে ব্যাকপেক নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেই কাল্পনিক চরিত্রকে তার আপনজনদের প্রায় সত্যিকার মানুষদের মতো দেখতে পেতাম। এক সময় সেই কিশোর আর তার প্রিয় মানুষদের সুখ-দুঃখ আর অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনীটা লিখতে বসেছি, গভীর ভালোবাসা নিয়ে লিখে শেষ করেছি। লেখা শেষ হলে নাম দিয়েছি দীপু নাম্বার টু! দীপু নাম্বার টু এখনও আমার খুব প্রিয় উপন্যাস। আমার খুব সৌভাগ্য এই দেশের ছেলেমেয়েরা এই উপন্যাসটিকে ঠিক আমার মতোই গভীর ভালোবাসার সাথে গ্রহণ করেছিল। প্রায় তিন দশক আগে লেখা এই উপন্যাসটি আজ আবার নূতন আঙ্গিকে সময় প্রকাশন থেকে বের হতে যাচ্ছে, এই সময়টিতে আমি আমার শিশু কিশোর পাঠক পাঠিকাদের গভীর মমতার সাথে স্মরণ করছি।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
১১.০৯.০৪
বনানী, ঢাকা
১.
ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে দীপুর হঠাৎ খুব খারাপ লাগল। প্রতি বছর ওর নতুন জায়গায় নতুন স্কুলে গিয়ে নতুন ক্লাসে ঢুকতে হয়। মোটামুটি ভাল ছাত্র সে–ফার্স্ট না হলেও পরীক্ষায় সেকেন্ড থার্ড হয় সহজেই। অথচ বরাবর ওর রোল নাম্বার হয় সাতচল্লিশ, না হয় আটান্ন। নতুন স্কুলে গেলে রোল নাম্বার তো পেছনে হবেই! রোল নাম্বারের জন্যে ওর তেমন দুঃখ নেই কিন্তু নিজের স্কুলে নিজের বন্ধুবান্ধবদের ছেড়ে নতুন জায়গায় অপরিচিত ছেলেদের মাঝে হাজির হতে ওর খুব বিচ্ছিরি লাগে। অথচ দীপুর প্রতি বছরই তা করতে হয়—ওর আব্বা শুধুমাত্র ওর জন্যেই নাকি এক বছর অপেক্ষা করেন, না হয় কোথাও নাকি তার তিন মাসের বেশি থাকতে ভাল লাগে না! পৃথিবীর সব কয়টা আব্বা একরকম, অথচ ওর আব্বা যে কেমন করে সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে গেলেন, দীপু এখনও বুঝে উঠতে পারে না।
ক্লাসটা বড়। দরজায় দাঁড়িয়ে সে দেখতে পায় হাজার হাজার মাথা-কুচকুচে কালো চুলের নিচে চকচকে চোখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। দীপু লক্ষ করে দেখেছে, প্রথম দিন ওর বরাবরই মনে হয় ক্লাসে হাজার হাজার ছেলে, পরে কেমন করে জানি কমে আসে। ক্লাস টীচারকে দেখে ওর ভয় হল। বদরাগী চেহারা রেজিস্টার খাতা খুলছেন রোল কল করার জন্যে। দীপু দরজায় দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে বলল, আসতে পারি?
চোখ না তুলে বদরাগী ক্লাস-টীচার ভারী গলায় বললেন, না।
সারা ক্লাস হো-হো করে হেসে উঠল, আর দীপু থতমত খেয়ে দুর্বল গলায় বলল, তা হলে কি পরে আসব?
না-তোকে আর আসতেই হবে না।
সারা ক্লাস আবার উচ্চস্বরে হেসে ওঠে—দীপু লক্ষ করল বদরাগী স্যারটির চোখেও কেমন হাসি ফুটে উঠেছে। সাথে সাথে হঠাৎ করে দীপু বুঝতে পারল, স্যার ওর সাথে মজা করছেন। যে স্যার প্রথম দিনেই কারো সাথে মজা করতে পারেন তিনি আর যা-ই হোক বদরাগী হতে পারেন না—দীপুর বুকে সাহস ফিরে আসে সাথে সাথে। সে একটু হেসে বলল, কিন্তু স্যার, আমাকে আসতেই হবে।
আসতেই হবে? স্যার খানিকক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, তা হলে
আয়
দীপু ভেতরে ঢুকল। স্যার কড় চোখে ওর দিকে তাকালেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এবারে বল, কেন তোকে আসতেই হবে।
আমি এই ক্লাসে ভর্তি হয়েছি।
গুল মারছিস?
না স্যার, সত্যি ভর্তি হয়েছি।
সত্যি? সত্যি।
ও! স্যার হতাশ হওয়ার ভান করে বললেন, তা হলে তো ওকে আসতে দিতেই হয়। কী বলিস তোরা?
পুরো ক্লাস মাথা নেড়ে সায় দিল! আর হঠাৎ করে দীপুর পুরো ক্লাস আর এই বদরাগী চেহারার মজার স্যার সবাইকে ভাল লেগে গেল। মাঝে মাঝে ওর এরকম হয়, হঠাৎ কাউকে ভাল লেগে যায়, কিন্তু পুরো ক্লাসকে একসাথে ভাল লেগে যাওয়া এই প্রথম।
এই স্কুলের নিয়ম-কানুন খুব কড়া জানিস তো?
দীপু মাথা নেড়ে বলল, সে জানে, যদিও ওর বিশ্বাস হচ্ছিল না। স্যার মুখ গম্ভীর করে বললেন, নতুন কেউ আসার পর তাকে একটা লেকচার দিতে হয়।
দীপু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায়?
এইখানে, ক্লাসের সামনে। তোকেও দিতে হবে।
দীপু মুখ কাচুমাচু করে বলল, আমি লেকচার দিতে পারি না স্যার—কোনদিন দেইনি।
সে আমি জানি না, তোকে দিতেই হবে। ঘড়ি ধরে পাঁচ মিনিট। স্যার হাত থেকে ঘড়ি খুলে চোখের সামনে ধরে বললেন, শুরু কর।
দীপুর মুখ শুকিয়ে গেল, শুকনো গলায় ঢোক গিলে আরেকবার স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল, সত্যি স্যার, আমি এতজনের সামনে লেকচার দিতে পারব না। লেকচার দিতে হলে কী বলতে হয় আমি জানি না স্যার।
দশ সেকেন্ড পার হয়ে গেছে! বল, তাড়াতাড়ি বল।
কী বলব, স্যার?
এই—তুই কী করিস, কী করতে ভালবাসিস, কী খাস, কী পড়িস এইসব বলবি। নে, শুরু কর–