মিঠুদের বাসায় গিয়ে দেখি সেখানে দাঁড়ানো ট্রাকগুলো নেই। ভেতরে মনে হয় মানুষজন আছে, তাদের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। আমাদের বয়সী ছেলে আছে কী নেই খোঁজটা কেমন করে নেওয়া যায় চিন্তা করছিলাম। টিটন বলল, “এতো ধানাই-পানাই করার কী আছে? গিয়ে জিজ্ঞেস করি। যদি থাকে ডেকে কথা বলব। যদি না থাকে তা হলে এবাউট টার্ন করে চলে আসব।”
আমরা রাজি হলাম। টিটন বাসার দরজা ধাক্কা দিল, দরজাটা খোলা। ইচ্ছে করলে আমরা ভিতরে ঢুকে যেতে পারি। মিঠু যখন ছিল তখন-যখন তখন ঢুকে গেছি। এখন ঢোকা উচিত হবে কি না বুঝতে পারলাম না। টিটন বলল, “আয় ঢুকে যাই! আমরা তো আর ডাকাতি করতে যাচ্ছি না।”
টিটনের পিছু পিছু আমরা ঢুকে গেলাম। ঘরের সব জায়গায় ফার্নিচার, বাক্স, মালপত্র ছড়ানো ছিটানো। একজন ভদ্রমহিলা তার মাঝে ছোটাছুটি করছেন। আমাদের ঢুকতে দেখে মুখ তুলে তাকালেন। টিটন মুখ খুললে একেবারে বেখাপ্পা কোনো একটা কথা বলে ফেলবে সে জন্যে আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “খালাম্মা আমরা এই পাড়ায় থাকি। আপনারা নতুন এসেছেন তাই দেখতে এসেছি।”
“হাউ সুইট। এসো বাবারা–দেখেছ ঘরের অবস্থাটা?”
অনু বলল, “আমাদের বাসাটা সবসময়ই এরকম থাকে।”
“তোমাদেরকে বসতে বলারও জায়গা নেই। কোনো একটা বাক্স-টাক্স খুঁজে তার ওপর বসে পড়।
চঞ্চল বলল, “আমাদের বসতে হবে না খালাম্মা।”
টিটন ধানাই-পানাই ছেড়ে সরাসরি কাজের কথায় চলে এলো, “খালাম্মা আমরা জানতে চাচ্ছিলাম আপনার আমাদের বয়সী ছেলে-টেলে আছে কি না!”
আমি তাড়াতাড়ি যোগ করলাম, “এই পাড়ায় আমরা একসঙ্গে থাকি, খেলাধুলা করি।”
অনু বলল, “দেয়াল পত্রিকা বের করি।” পুরো মিথ্যা কথা কিন্তু আমরা এখন সেটা প্রকাশ করলাম না।
ভদ্রমহিলা খুশি হয়ে উঠলেন, বললেন, “অবশ্যিই তোমাদের বয়সী ছেলেমেয়ে আছে। হাউ সুইট। আমার এক ছেলে আর এক মেয়ে। একজন ছোট, একজন তোমাদের বয়সী। এসে থেকে ঘ্যান ঘ্যান করছে। ঢাকার সব বন্ধু বান্ধব ছেড়ে চলে এসেছে তো, তাই মন খারাপ। তোমরা ধরে নিয়ে যাও, তা হলে মন ভালো হয়ে যাবে।”
শুনে আমাদেরও মন ভালো হয়ে গেল। ভদ্রমহিলা এতো ভালো, ছেলেটাও ভালো হবার কথা।
ভদ্রমহিলা ডাকলেন, “এই টুনি-টুটুল দেখে যা, কে এসেছে।”
প্রথমে এলো টুটুল-ছেলে। তাকে দেখেই আমাদের বুক ধড়াস করে উঠল কারণ তার বয়স চার থেকে পাঁচ বছর, তার মানে আমাদের বয়সী যে, সে হচ্ছে মেয়ে! আমরা ছেলের খোঁজে এসেছি মোটেই মেয়ের খোঁজে আসিনি। মেয়েদের নিয়ে আমাদের জীবনে ভয়ংকর ভয়ংকর অভিজ্ঞতা আছে। আমরা মেয়েদের থেকে একশ হাত দূরে থাকি। আমার বাসায় মিথিলা একা আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে, সারাক্ষণ আম্মুর কাছে নালিশ। সারাক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান। বাইরের কথা স্কুলের কথা ছেড়েই দিলাম।
আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। চোখের দৃষ্টি দিয়ে টিটন বলল, “চল পালাই।”
কিন্তু সত্যি সত্যি তো পালানো যায় না। তাই আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম আর তখন টুনি বের হয়ে এলো। আমাদের বয়সী, শুকনো কিন্তু মনে হয় আমাদের থেকে একটু লম্বা। শ্যামলা, মাথার চুল ছোট করে কাটা। একটা জিনসের প্যান্ট আর ঢলঢলে টি-শার্ট পরে আছে। মেয়েটার কাপড়, চেহারা, সাইজ–যেরকমই হোক তার চোখ দুটি দেখেই আমরা বুঝে গেলাম এই মেয়েটার কারণে আমাদের কপালে দুঃখ আছে।
ভদ্রমহিলা বললেন, “এই দ্যাখ টুনি, এরা কতো সুইট। নিজেরা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে ওদের বয়সী ছেলেমেয়ে আছে কি না। আর তুই বলছিলি তোকে জঙ্গলে নিয়ে এসেছি! এখানে কথা বলার কেউ নাই।”
টিটন দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে আমাকে বলল, “ছেলেমেয়ে বলি নাই। শুধু ছেলে বলেছি।” কথাটা অবশ্যি আমি ছাড়া আর কেউ শুনল না।
মেয়েটি আমাদের দিকে আর আমরা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভদ্রমহিলা বললেন, “যা টুনি, এদের সঙ্গে ঘুরে আয়। সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত, পরিচয় করে আয়।”
মেয়েটা হ্যাঁ না কোনো কথা বলল না, ঘরে ঢুকে পায়ে স্যান্ডেল পরে বের হয়ে এলো। ভদ্রমহিলা আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের নাম তো জানা হল না!”
আমরা আমাদের নাম বললাম, ভদ্রমহিলা একবার করে উচ্চারণ করে বললেন, “যাও বাবা তোমরা এই মেয়েটাকে একটু ঘুরিয়ে আন। দেখো ওর মনটা একটু ভালো হয় কী না।”
মেয়েটা আমাদের পিছু পিছু বের হয়ে এলো, বাইরে বের হয়ে আমার মনে হল ভুলটা এখনই ভেঙে দেওয়া ভালো। আমরা যে মোটেও কোনো মেয়ের খোঁজে যাইনি, ছেলের খোঁজে গিয়েছি সেটা মেয়েটাকে এখনই জানিয়ে দেওয়া দরকার। আমি গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, “ইয়ে মানে, টুনি, একটা জিনিস আগে একটু বলে নিই।”
টুনি আমার দিকে তাকাল, চোখের দৃষ্টিটা একেবারে বরফের মতো ঠাণ্ডা। আমি বললাম, “আসলে একটা ভুল হয়ে গেছে। আমরা আসলে তোমার আম্মুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমাদের বয়সী কোনো ছেলে আছে কি না। ছেলে, বুঝেছ তো?”
টুনি মাথা নেড়ে জানাল যে সে বুঝেছে। আমি তবুও ঝুঁকি নিলাম না, আরো পরিষ্কার করে দিলাম, “আমরা কিন্তু, মানে, ইয়ে মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করি নাই। তাই তোমার কষ্ট করে আমাদের সাথে সাথে যাবার কোনো দরকার নাই। তুমি ইচ্ছে করলে এখন বাসায় চলে যেতে পার।”