মিশকাত মঞ্জিলের দারোয়ান সেই মাকে বাড়ির সামনে থেকে তাড়িয়ে দিল। মা কোথায় গেল সেটা আর কেউ জানতে পারল না। কিন্তু তারপর মিশকাত মঞ্জিলে ভয়ংকর সব ব্যাপার ঘটতে থাকল। সবার আগে মারা গেল মিশকাত খানের ছোট বউ। মিশকাত খান অপূর্ব সুন্দরী একটা মেয়েকে জোর করে ধরে এনে বিয়ে করেছিল। সেই বউয়ের সারা শরীরে দেখা গেল গুটি বসন্ত। ভুগে ভুগে মারা গেল সে। বসন্ত রোগের ভয়ে তার অনেক কর্মচারী ও কাজের লোক পালিয়ে গেল। ছোট বউ মারা যাবার কিছুদিন পর বড় বউ গলায় দড়ি দিয়ে মারা গেল। তারপর তার ছেলেমেয়েগুলো একজন একজন করে মারা যেতে লাগল। একজন মারা গেল পানিতে ডুবে। একজন মারা গেল পাগলা কুকুরের কামড়ে। একজন মারা গেল আগুনে পুড়ে। একজন মারা গেল বিষ খেয়ে। ঝড়ের রাতে একজন মাথায় বাজ পড়ে মারা গেল। একজন মারা গেল বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে। শেষ জনের লাশ পাওয়া গেল জঙ্গলে, মুখটা কেউ খুবলে খুবলে নিয়ে গেছে, কীভাবে নিয়েছে কেউ জানে না। এই বাড়িতে অন্য যারা ছিল তখন তারাও একজন একজন করে চলে গেল। পুরো বাড়িতে রয়ে গেল শুধু মিশকাত খান একা।
আস্তে আস্তে মিশকাত খানের মাথা খারাপ হয়ে গেল। মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল, কোটরের মাঝে লাল জ্বলজ্বল চোখ, লম্বা লম্বা নখ। সে একা একা এই বাড়িতে ঘুরে বেড়ায় আর বিড়বিড় করে নিজের সাথে কথা বলে।
এই এলাকার অনেক মানুষ দেখেছে গভীর রাতে মিশকাত খান তার বাড়ির ছাদের রেলিং ধরে হাঁটছে আর তার পিছু পিছু সাদা কাপড় পরা অনেকগুলো ছায়ামূর্তি হাঁটছে। সবাই ধারণা করে সেগুলো মিশকাত খানের বউ ছেলেমেয়ের প্রেতাত্মা। সেগুলো কোনো কথা বলে না, নিঃশব্দে মিশকাত খানের পিছনে হেঁটে যায়।
আরো যখন রাত গম্ভীর হয় তখন একটা ছোট মেয়ের ইনিয়ে-বিনিয়ে কান্নার শব্দ শোনা যায়–কখনো কখনো আবার খিলখিল করে রক্ত শীতল করা হাসি।
কাজেই অনু যখন মিশকাত মঞ্জিলের কথা বলল, আমরা সবাই রীতিমতো চমকে উঠলাম। টিটন বলল, “সর্বনাশ! ঐ ভূতের বাড়িতে? আমি ওর মাঝে নাই।”
আমিও মাথা নাড়লাম, বললাম, “মাথা খারাপ? আমাদের জানের মায়া নাই?”
চঞ্চল বলল, “জানের মায়া? তোর জান কে নিতে আসছে?”
“ভূত।”
চঞ্চল বলল, “এই দুপুরবেলা কটকটে রোদের মাঝে তোর ভূতের কথা বলতে লজ্জা করল না?”
“এখন কটকটে রোদ ঠিক আছে। যখন সন্ধ্যা হবে তখন? যখন রাত হবে তখন? তুই তখন যেতে পারবি মিশকাত মঞ্জিলে?”
চঞ্চল গম্ভীর গলায় বলল, “পারব।”
টিটন বলল, “থাক। এতো সাহসের দরকার নাই।”
“এর মাঝে সাহসের কিছু নাই।”
চঞ্চল গম্ভীর গলায় বলল, “ভূত বলে কিছু নাই। যদি থাকত তা হলে এতোদিনে ভূতকে বৈজ্ঞানিকেরা ধরে ফেলত। ভূতদের চিড়িয়াখানা থাকত, সেখানে নানা রকম ভূত থাকত। আমরা টিকিট কেটে সেই সব ভূত দেখতে যেতাম।”
আমি বললাম, “বেশি বড় বড় কথা বলবি না। ভূতেরা যদি তোর কথা শুনে তা হলে তোর খবর আছে।”
চঞ্চল বলল, “কেন? কী হবে?”
“তোকে ধরে নিয়ে তাদের চিড়িয়াখানায় আটকে রাখবে। ভূতের বাচ্চারা টিকিট কেটে তোকে দেখতে আসবে!”
আমার কথা শুনে চঞ্চল হি হি করে হাসল যেন আমি খুব একটা মজার কথা বলেছি।
আমরা কথা বলতে বলতে হাঁটতে হাঁটতে কীভাবে কীভাবে জানি মিশকাত মঞ্জিলের কাছেই চলে এসেছি খেয়াল করিনি। ভাঙা গেটটার সামনে আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম, টিটন ভেতরে উঁকি দিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে বলল, “বাবারে বাবা!”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী?”
“কিছু না।”
“তা হলে বাবারে বাবা বললি কেন?”
“ইচ্ছে হয়েছে তাই বলেছি। আমার ইচ্ছে হলে আমি বাবারে বাবা বলব, মা’রে মা বলব, চাচারে চাচা বলব, তোর কী?”
এই হচ্ছে আমাদের টিটন। তার সাথে কথা বলাই মুশকিল! কথায় কোনো ছিরি ছাদ নেই, কোনো যুক্তি নেই।
চঞ্চলও ভাঙা গেটটা দিয়ে ভিতরে উঁকি দিল। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আয় ভেতরে ঢুকি।”
টিটন বলল, “তোর মাথা খারাপ হয়েছে?”
“মাথা খারাপের কিছু হয় নাই। চল ভেতরটা কেমন দেখে আসি।”
আমরা কেউ ঢুকতে রাজি হলাম না বলে চঞ্চল একাই রওনা দিল। সেটা প্রমাণ করে আমরা সবাই ভীতুর ডিম তাই আমিও শেষ পর্যন্ত চঞ্চলের সাথে ভেতরে যেতে রাজি হলাম। আমাদের দুজনকে ভেতরে ঢুকতে দেখে অনুও ভেতরে যেতে রাজি হল তখন টিটনের আর না যেয়ে উপায় থাকল না। এমনিতে অন্য সবকিছুতে টিটনের সাহসের কোনো অভাব নেই কিন্তু ভূতের ব্যাপার হলেই তার এক ফোঁটা সাহস থাকে না।
মিশকাত মঞ্জিলের ভেতরে আমরা কখনো উঁকি দেইনি, আজ ভেতরে ঢুকে আবিষ্কার করলাম সেখানে অনেক জায়গা। বড় বড় গাছ, সেই গাছে পাখি কিচিরমিচির করছে। আসলে দালানটি বেশ অদ্ভুত, দেয়ালটি দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কোনো দরজা-জানালা নেই। আমরা চঞ্চলের পিছু পিছু পুরো দালানটার চারদিক দিয়ে একবার ঘুরে এলাম। তখন টিটন বলল, “অনেক দেখা হয়েছে, আয় এখন যাই।”
চঞ্চল বলল, “এসেছি যখন তখন বিল্ডিংয়ের ভেতরটা দেখে যাই।”
টিটন বলল, “ভেতরে? সর্বনাশ!”
“সর্বনাশের কী আছে? দেখছিস না এখানে কিছু নাই।”
চঞ্চল একাই বিল্ডিংয়ের ভেতর ঢুকে গেল তাই শেষ পর্যন্ত আমরাও তার পিছু পিছু গেলাম। ভেতরে অনেকগুলো ঘর, সব ঘরই ফাঁকা। এক-দুইটা ঘরের দরজা আছে, বহুদিন ব্যবহার করা হয়নি বলে কজায় মরচে পড়ে গেছে। খোলার সময় ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে। দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যাওয়া যায়। সেখানে একটা বারান্দা, গাছের পাতা, জঙ্গল আর খড়কুটো দিয়ে ঢেকে আছে। দেয়ালে শ্যাওলা পড়েছে, এক জায়গায় ইটের ফাটলে একটা বট গাছ। দোতলার ঘরগুলো বেশ বড়। বহুদিন কেউ ব্যবহার করেনি তাই ধুলোবালি, গাছের পাতা, খড়কুটো দিয়ে বোঝাই। পিছনের দিকে একটা অংশের ছাদ ধসে পড়েছে, মনে হয় এদিকে আগুন লেগেছিল তাই সবকিছু পুড়ে গেছে।