“কেন?”
“বাসায় কেউ আমাদের কোনো পাত্তা দেয় না। কী বলি না বলি কেউ কিছু শুনে না। তোরা নিশ্চিন্ত মনে কথা বলতে পারিস।”
“ধুর! সবাই শুনছে আমাদের কথা।”
“শুনছে না।”
“শুনছে।”
অনু বলল, “ঠিক আছে দশ টাকা বাজি। কেউ শুনছে না।”
আমি রাজি হয়ে গেলাম, বললাম, “ঠিক আছে।”
চঞ্চল বলল, “কিন্তু কেমন করে বুঝব কেউ শুনছে না কী শুনছে না?”
অনু বলল, “খুব সোজা। তোরা শুধু লক্ষ কর।”
আমরা লক্ষ করলাম, অনুর আপু যখন ডাইনিং টেবিলের কাছে ফ্রিজ থেকে কিছু একটা বের করছে তখন অনু আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, “তোরা সবাই বোতলে করে কেরোসিন নিয়ে আসবি। সাথে ম্যাচ। বোতলের কেরোসিনটা ঢালব ঘরটাতে তারপর আগুন ধরিয়ে দিব। কাছে শুকনো গাছটাতে যখন আগুন লেগে যাবে তখন আর চিন্তা নাই, দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকবে সারারাত।”
অনুর এই ভয়ংকর পরিকল্পনা তার আপু শুনল বলে মনে হল না। নিজের মতো কাজ করতে লাগল। তারপর আবার বসার ঘরে চলে গেল।
অনু বলল, “দেখেছিস?”
অন্যেরা মাথা নাড়ল, বলল, “অনু ঠিকই বলেছে। আমাদের কথা কেউ মন দিয়ে শুনে না!”
অনু হাত পেতে বলল, “আমার দশ টাকা দে।” আমি অনেক কষ্টে দশটা টাকা জোগাড় করেছিলাম অনুকে দিয়ে দিতে হল!
বোঝাই যাচ্ছে কেউই আমাদের কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনছে না। আমরা আমাদের সবচেয়ে গোপন কথাগুলো এখানে বসেই বলতে পারব কোনো সমস্যা হবে না, তারপরেও আমরা ঠিক করলাম আমাদের বাকি আলাপ আমরা বাসার বাইরে গিয়ে করব।
যখন আমরা বের হয়ে যাচ্ছি অনুর আপু আমাদের বিদায় দিয়ে দরজা বন্ধ করতে গিয়ে থেমে গিয়ে অনুকে বলল, “বেশি করে আনতে বলিস।”
অনু অবাক হয়ে বলল, “কী বেশি করে আনতে বলব?”
“কেরোসিন! আগুন লাগানো কিন্তু এতো সোজা না।”
অনু চিৎকার করে বলল, “আপু! তুমি আমাদের কথা শুনছিলে? তা হলে না শোনার ভান করলে কেন?”
অনুর আপু উত্তর না দিয়ে দরজা বন্ধ করতে করতে দরজার ফাঁক দিয়ে বললেন, “আমার কিন্তু কালা গুইসাপ নামটাই বেশি পছন্দ!”
এবার শুধু অনু না, আমরাও চিৎকার করে উঠলাম, “আপনি আমাদের সব কথা শুনেছেন!”
“চোখের তো পাতি আছে তাই চোখ বন্ধ রাখা যায়। কানের তো পাতি নাই!” না চাইলেও সব কথা শুনতে হয় বলে অনুর আপু আমার দিকে তাকাল, বলল, “রাতুল! আমি তোমার সাথে জন্মেও কোনোদিন লটারি করব না! বাবারে বাবা!”
কথা শেষ করে অনুর আপু বাম চোখটা দিয়ে খুব সূক্ষ্মভাবে চোখ টিপলেন। শুধু আমি দেখলাম, আর কেউ দেখল না। কেন পিলেন সেটাও শুধু আমি বুঝলাম আর কেউ বুঝল না।
ঘর থেকে বের হয়ে আমি অনুর দিকে হাত পেতে বললাম, “আমার দশ টাকা ফেরত দে।”
অনু বিরস মুখে আমার টাকা ফেরত দিল। আমি বললাম, “এখন তোর আমার বাজির টাকা দেওয়ার কথা ছিল। যা, তোকে মাফ করে দিলাম! দিতে হবে না।”
আমরা যখন মাঠের মাঝখান দিয়ে যাচ্ছি তখন দেখলাম মিঠুদের বাসার সামনে। একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। সেই ট্রাক থেকে মালপত্র নামানো হচ্ছে। আমি বললাম, “মিঠুদের বাসায় নতুন মানুষ এসেছে!”
আমরা খানিকক্ষণ দেখার চেষ্টা করলাম সেখানে আমাদের বয়সী কোনো ছেলেকে দেখা যায় কি না-দেখতে পেলাম না। বিকালবেলা এসে খোঁজ নিতে হবে। আমাদের কপাল সাধারণত ভালো হয় না, আমাদের বয়সী ছেলে পাওয়া যাবে না। যদিও বা পাওয়া যায় তা হলে নির্ঘাত সে হবে চূড়ান্ত পাজী যার তুলনায় টিটনকে মনে হবে ফেরেশতা!
.
০২.
অনুর বাসা থেকে বের হয়ে আমরা চারজন কথা বলতে বলতে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছি। চঞ্চল বলল, “বুঝলি, ভালো একটা ক্লাব মানে হচ্ছে ভালো একটা আস্তানা।”
টিটন বলল, “ঠিক বলেছিস।”
অনু বলল, “নামটা যখন ভালো হল না, তখন আস্তানাটা খুব ভালো হওয়া দরকার।”
আমি চোখ পাকিয়ে বললাম, “কী বললি? নামটা ভালো হয় নাই?”
“হয় নাই তো। কালা গুইসাপ একটা নাম হল?”
“মোটেও নাম কালা গুইসাপ না, নাম হচ্ছে ব্ল্যাক ড্রাগন!”
“ঐ একই কথা। ইংরেজিতে ব্ল্যাক ড্রাগন বাংলায় কালা গুইসাপ।”
আমি রেগেমেগে বললাম, “বাংলায় মোটেও কালো গুইসাপ না।”
“তা হলে বাংলায় কী?”
“এটা একটা নাম। নামের আবার বাংলা ইংরেজি আছে? রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে কী তুই নবাব বাঙ্গাল বাঘ বলিস?”
আমার কথা শুনে চঞ্চল হি হি করে হাসতে লাগল। বলল, “নবাব বাঙ্গাল বাঘ! এই নাম শুনলে সুন্দরবনের সব রয়েল বেঙ্গল টাইগার সুইসাইড করবে!”
টিটন বলল, “ঐসব ছেড়ে এখন বল আমাদের ক্লাবের আস্তানাটা কোথায় হবে। গোপন আস্তানা হতে হবে, কেউ যেন জানতে না পারে।”
চঞ্চল বলল, “আমাদের বাসার দোতলায় হতে পারে। আমি যে ঘরটা ল্যাবরেটরি বানিয়েছি তার পাশের ঘরটা খালি আছে।”
আমি বললাম, “উঁহু। কারো বাসায় বানানো যাবে না। তা হলে সবাই জেনে যাবে।”
“তা হলে কোথায় বানাবি?”
চঞ্চল বলল, “একটা ট্রি হাউজ বানালে কেমন হয়?”
“ট্রি হাউজ?”
“হ্যাঁ। গাছের উপরে একটা গোপন আস্তানা।”
“কোন গাছে?”
“একটা গাছ খুঁজে বের করতে হবে। বড় একটা গাছ।”
অনু বলল, “মিশকাত মঞ্জিলে বড় বড় গাছ আছে।”
“মিশকাত মঞ্জিল!” আমাদের সবার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
মিশকাত মঞ্জিল শুনে চোখ বড় বড় হওয়ার কারণ আছে। আমাদের পাড়া থেকে নদীর দিকে কিছু দূর হেঁটে গেলে দেয়াল ঘেরা যে বিশাল জায়গাটা আছে তার ভেতরে মিশকাত মঞ্জিল। বাইরে থেকে বোঝা যায় না ভেতরে একটা বড় দালান আছে, গাছপালা ঝোঁপঝাড় দিয়ে ঢাকা তাই পুরানো দালানটা দেখাও যায় না। এক সময় সেখানে মানুষজন থাকত, আজকাল কেউ থাকে না। কেন থাকে না সেটা নিয়ে নানা রকম গল্প চালু আছে। সবচেয়ে বেশি চালু গল্পটা হচ্ছে এরকম : এই বাড়ির মালিক মিশকাত খান খুবই অত্যাচারী ধরনের মানুষ ছিল, তার না কী ডাকাতের দল ছিল। মিশকাত খানের বাসায় ছোট একটা বাচ্চা মেয়ে কাজ করত। একদিন হঠাৎ করে সেই ছোট মেয়েটা অদৃশ্য হয়ে গেল। মেয়েটার বাবা নেই, মা খোঁজ পেয়ে এসেছে মিশকাত খানের সাথে দেখা করতে। মিশকাত খান মা’কে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। বাচ্চা মেয়েটির মা তখন মিশকাত মঞ্জিলের বাইরে দাঁড়িয়ে দুই হাত উপরে তুলে খোদার কাছে বলেছে, “খোদা যেই মানুষ আমার মাসুম বাচ্চাকে খুন করেছে তুমি তাকে নির্বংশ করে দাও। আমার আদরের ধনকে যে নিয়ে গেছে তুমি তার আদরের ধনকে নিয়ে যাও। সে আমাকে যে কষ্ট দিয়েছে তুমি তাকে সেই কষ্ট দাও। তার মুখে পানি দেবার জন্যে যেন কেউ না থাকে। শিয়াল-কুকুর যেন তার লাশ টেনে ছিঁড়ে খায়।”