“অয়লার?” টিটন ভুরু কুঁচকে বলল, “মানে তৈলাক্ত? আমাদের ক্লাবের নাম কেন তৈলাক্ত হবে? আমরা কী লোকজনকে তেল দিয়ে বেড়াব না কি?”
চঞ্চল গরম হয়ে বলল, “অয়লার মানে তৈলাক্ত না গাধা। অয়লার হচ্ছেন একজন বিশাল গণিতবিদ।” নামটা উচ্চারণ করতেই চঞ্চলের মুখে একটা গভীর শ্রদ্ধা শ্রদ্ধা ভাব চলে আসছিল, “খুব কম বয়সে অয়লার অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন সেই অন্ধ অবস্থাতে গবেষণা করেছেন।”
অনু বলল, “সবাই একটা নাম বলেছে, রাতুল এখনো কোনোটা বলে নাই। রাতুল তুই একটা নাম বল।”
“আমি?”
“হ্যাঁ”
“ব্ল্যাক ড্রাগন।”
“ব্ল্যাক ড্রাগন?” চঞ্চল ভুরু কুঁচকে বলল, “ড্রাগন বলে কিছু নাই তুই জানিস? ড্রাগন ফ্লাই আছে। ড্রাগন ফ্লাই মানে হচ্ছে ফড়িং। তুই আমাদের ক্লাবের নাম রাখতে চাস ফড়িং?”
আমি রেগে বললাম, “মোটেও আমি ফড়িং রাখতে চাই না। তা হলে বলতাম ড্রাগন ফ্লাই। আমি কী ড্রাগন ফ্লাই বলেছি? বলি নাই। বলেছি ব্ল্যাক ড্রাগন।”
চঞ্চল মুখটা ভোলা করে বসে রইল। অনু বলল, “নামটার মাঝে কোনো সৌন্দর্য নাই। বাংলা করলে হবে কালা গুইসাপ। কালা গুইসাপ কোনো নাম হল?
আমি আরো রেগে উঠলাম, “ড্রাগনের বাংলা মোটেও গুইসাপ না।”
“ড্রাগনের বাংলা তা হলে কী?”
“ড্রাগনের বাংলা ড্রাগন।”
টিটন বলল, “ঝগড়াঝাটি বন্ধ করে আমার নামটা রেখে দে ব্লাড অ্যান্ড মার্ডার।”
আমি বললাম, “তার চাইতে একটা কাজ করা যাক।”
“কী কাজ।”
“আমরা সবাই একটা একটা করে নাম বলি। সেই নামগুলো আলাদা আলাদা কাগজের টুকরায় লিখব। তারপর লটারি করে যার নাম উঠবে সেইটাই হবে ক্লাবের নাম।”
“লটারি?”
“হ্যাঁ। এ ছাড়া আর উপায় কী? তোরা কী ভাবছিস কোনোদিন আমরা একজনের নামে আরেকজন রাজি হব? হব না।”
চঞ্চল মাথা নাড়ল, বলল, “সেটা ঠিক।”
অনু ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বড় মানুষের মতো বলল, “এই জন্যে বাঙালি জাতির উন্নতি হচ্ছে না। আমাদের মাঝে পরমতসহিষ্ণুতা নাই।”
টিটন বলল, “কী নাই?”
”পরমতসহিষ্ণুতা।”
“সেইটা আবার কী জিনিস? জীবনেও এর নাম শুনি নাই।”
“তোর মাঝে এটা নাই সেই জন্যে তুই এর নাম শুনিস নাই।”
আমি বললাম, “জ্ঞানের কথা বাদ দিয়ে একটা কাগজ কলম নিয়ে আয়।”
অনু উঠে গিয়ে কাগজ কলম নিয়ে এলো।
আমি কাগজটা চার টুকরা করে বললাম, “এখন একজন একজন করে তোদর পছন্দের নামগুলো বল, আমি লিখি।”
টিটন বলল, “রাড অ্যান্ড মার্ডার।”
আমি কাগজে লিখলাম ব্ল্যাক ড্রাগন-একটু আড়াল করে লিখলাম যেন কেউ দেখতে না পায়, তারপর কেউ দেখার আগে কাগজটা ভাঁজ করে ফেললাম।
চঞ্চল বলল, “অয়লার।” আমি লিখলাম ব্ল্যাক ড্রাগন। অনু বলল, “সোনালী ডানা।” আমি লিখলাম ব্ল্যাক ড্রাগন।
তারপর আমি নিজেরটা লিখলাম-ব্ল্যাক ড্রাগন। কাগজগুলো ভাজ করে টেবিলে রেখে আমি গম্ভীরভাবে বললাম, “এই লটারিতে আমাদের কোনো একজনের দেওয়া নাম উঠবে। অন্য সবাইকে সেটা মানতে হবে। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে।”
“সবাই একজন আরেকজনের গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর।”
চঞ্চল বলল, “গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলে কী হয়?”
“জানি না। মনে হয় প্রতিজ্ঞা ভাঙলে সে মরে যায়।”
চঞ্চল বাকা করে হেসে বলল, “তোকে বলেছে! মরে যাওয়া যেন এতো সোজা!”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “বকর বকর না করে প্রতিজ্ঞা কর।”
আমরা তখন একজন আরেকজনকে ধরলাম আর অনু আমাদের প্রতিজ্ঞা। করাল, “আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, আমরা এই লটারির ফলাফল মানিয়া চলিব। লটারিতে যাহাই উঠিবে তাহাই আমাদের ক্লাবের নাম হইবে। এই নাম নিয়া ভবিষ্যতে কেহ কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করিব না।”
আমি তখন কাগজের টুকরাগুলো টেবিলে খুব ভালোভাবে ওলট-পালট করে মিশিয়ে দিয়ে বললাম, “এখন একজনকে একটা কাগজ তুলতে হবে। কে তুলবি?”
কোনো প্রশ্ন উহ আমাদের ক্লাকে লটারির ফলাফলীয়াদের প্রতিজ্ঞা
কেউ কিছু বলার আগেই টিটন বলল, “আমি! আমি!”
“ঠিক আছে। আগে চোখ বন্ধ কর।”
টিটন চোখ বন্ধ করে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে একটা কাগজ তুলল, আমি বাকি কাগজগুলো সরিয়ে নিলাম। অনু বলল, “খোল।”
টিটন বলল, “ভয় লাগছে। যদি আমারটা না ওঠে?” অনু বলল, “আমারও ভয় লাগছে, যদি তোরটা ওঠে!” চঞ্চল বলল, “অনেক হয়েছে এখন খোল।”
টিটন তখন কাঁপা হাতে কাগজের ভাঁজ খুলল, আর আমি কাগজের মাঝে ব্ল্যাক ড্রাগন লেখা দেখে আনন্দে চিৎকার করে লাফাতে লাগলাম। খুশি হবার পুরো অভিনয়টা হল একেবারে ফাটাফাটি। কেউ কিছু সন্দেহ করল না।
অনু বিরক্ত হয়ে বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, অনেক হয়েছে। এখন থাম।”
চঞ্চল ফেস করে একটা নিশ্বাস ফেলল, কিছু বলল না। টিটন বলল, “আমার লটারির কপালটাই খারাপ। জীবনে কোনো লটারিতে জিতি নাই। রাজি হওয়াটাই ঠিক হয় নাই।”
আমি বললাম, “এসব বলে কোনো লাভ নাই। এখন নাম ঠিক হয়ে গেছে, এই নামটাই সবার মেনে নিতে হবে।”
অনু গজগজ করে বলল, “ঠিক আছে ঠিক আছে।”
টিটন বলল, “আর ক্লাবের পুরো কাজ হবে গোপনে। পৃথিবীর আর কেউ এর কথা জানবে না।”
অনু বলল, “ঠিক আছে। ঠিক আছে।”
আমি বললাম, “তা হলে এখানে বসে আমরা কথা বলছি কেন? সবাই আমাদের কথা শুনে ফেলছে না?”
আমরা ডাইনিং টেবিলে বসে কথা বলছি, অনুর আম্মু মাঝে মাঝে এদিক সেদিক দিয়ে হাঁটছেন। অনুর বোন হাঁটছে, তারা নিশ্চয়ই সবাই আমাদের কথাবার্তা সবকিছু শুনছে। অনু মাথা নেড়ে বলল, “কেউ আমাদের কথা শুনছে না।”