ঠিক কী বললে ভালো হবে বুঝতে পারলাম না বলে হাসি হাসি মুখ করে বললাম, “না মানে ইয়ে, অনু এখনো বের হচ্ছে না তাই ভাবলাম”
“আর আমার কাছে অনুর কথা বল না! তাকে ধাক্কাধাক্কি করেও ভোলা যায় না! যাও দেখি, চেষ্টা করে দেখ ঘুম থেকে তুলতে পার কী!”
টিটন বলল, “আপনি চিন্তা করবেন না খালাম্মা, আমরা এক্ষুণি তুলে দেব।”
চঞ্চল বলল, “আমার ইনডাকশন কয়েলটা নিয়ে আসা উচিত ছিল। পায়ের আঙুলে বেঁধে একটা শক দিতাম, চিড়িক করে লাফ দিয়ে উঠত।”
আমি বললাম, “ইনডাকশন কয়েল ফয়েল লাগবে না, আমরা ধাক্কাধাক্কি করে তুলে ফেলব।”
কাজটা অবশ্যি এতো সহজ হল না। আমরা তার ঘরে গিয়ে অনুকে ধাক্কাধাক্কি করলাম, অনু আঁ উঁ করে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। তখন আমরা শেষ পর্যন্ত ধাক্কা দিয়ে অনুকে বিছানা থেকে ফেলে দিলাম, ধড়াস করে বিছানা থেকে নিচে পড়ে শেষ পর্যন্ত সে চোখ পিটপিট করে বলল, “ও! তোরা।”
আমি বললাম, “হ্যাঁ, আমরা। এখনো ঘুমাচ্ছিস? আজ থেকে স্কুল ছুটি জানিস না?”
অনু ঘুম ঘুম গলায় বলল, “সেই জন্যেই তো ঘুমাচ্ছি।”
“ছুটির সময়টা ঘুমিয়ে নষ্ট করবি না কি গাধা কোথাকার?”
“তা হলে কী করব?”
আমি বললাম, “আমরা একটা ক্লাব করব ঠিক করেছি।”
“ক্লাব?” অনু চোখ বড় বড় করে বলল, “সাহিত্য ক্লাব? সবার কাছ থেকে গল্প, কবিতা নিয়ে দেয়াল পত্রিকা বের করব?”
চঞ্চল বলল, “কীসের ক্লাব সেইটা এখনো ঠিক হয় নাই। সায়েন্স ক্লাবও হতে পারে–”
টিটন বলল, “ডিটেকটিভ ক্লাবও হতে পারে।”
আমি বললাম, “ফুটবল না হয় ক্রিকেট ক্লাবও হতে পারে।”
সাহিত্য ক্লাবকে বেশি পাত্তা দিলাম না বলে অনুর মনটা একটু খারাপ হল, তাই আমি তার মন ভালো করার জন্যে বললাম, “আবার সবকিছু মিলিয়েও একটা ক্লাব হতে পারে! যেটা বৈজ্ঞানিক গবেষণা করবে আবার ফুটবল খেলবে আবার ডিটেকটিভ কাজ করবে। আমরা এখনো ঠিক করি নাই।”
থাকতাম অনুর আম্মু মজারীও বসে গেমা তো তাকে আর
টিটন বলল, “সেটা ঠিক করার জন্যেই এসেছি। চারজনে মিলে ঠিক করব।” আমি ধাক্কা দিয়ে বললাম, “ওঠ। ঘুম থেকে ওঠ।–”
অনু এবারে উঠল। হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা খেতে বসল। আমরা তো তাকে আর একা একা বসতে দিতে পারি না, তাই আমরাও বসে গেলাম। ঠিক আমরা যেরকম ভেবেছিলাম সেরকম অনুর আম্মু মজার মজার নাস্তা নিয়ে এলেন! আমরা যদি এই বাসায় থাকতাম তা হলে আমরাও নির্ঘাত অনুর মতো গোলগাল মোটাসোটা নাদুস-নুদুস হয়ে যেতাম। খেতে খেতে আমরা ক্লাব নিয়ে কথা বলতে থাকি। টিটন বলল, “বুঝলি, ভালো ক্লাব মানে হচ্ছে ভালো একটা নাম। একেবারে ফাটাফাটি একটা নাম। যেমন ধর ব্লড অ্যান্ড মার্ডার।” নামটা আমাদের কেমন পছন্দ হয়েছে সেটা বোঝার জন্যে টিটন আমাদের সবার মুখের দিকে তাকাল।
চঞ্চল ইতস্তত করে বলল, “ব্লাড অ্যান্ড মার্ডার? কীসের ব্লড? আর কে মার্ডার করবে? আমরা মার্ডার করব না কী আমাদের মার্ডার করবে?”
“ধুর গাধা।” টিটন বিরক্ত হয়ে বলল, “কেউ কাউকে মার্ডার করবে না। এটা একটা নাম। যেন নামটা শুনলেই মনে হয় সাংঘাতিক কিছু।”
অনু বলল, “ওহ। ইংরেজি নাম দিবি কেন? আমরা বাঙালি, তাই নামটা হবে বাংলা। আমাদের চারজনের ক্লাব তাই এটার নাম দিতে পারি চতুর্ভুজ। কিংবা চতুষ্কোণ।”
টিটন হই হই করে উঠল, “কক্ষনো না। মনে হচ্ছে জ্যামিতির ক্লাস! আমরা কী অঙ্কের ক্লাব করছি না কি?”
চঞ্চল গম্ভীর হয়ে বলল, “করলে দোষ আছে? পৃথিবীতে গণিতের ক্লাব নাই? বাংলাদেশে আছে। তারা অলিম্পিয়াডে গিয়ে মেডেল আনে।”
টিটন বলল, “মেডেলের খেতা পুড়ি। আমরা কী মেডেলের জন্যে ক্লাব বানাচ্ছি? মোটেই না। চতুর্ভুজ, চতুষ্কোণ-এইসব শুনলেই আমার জ্যামিতির ক্লাসের কথা মনে হয়। আর জ্যামিতি ক্লাসের কথা মানেই জ্যামিতি স্যারের কথা মনে হয় আর জ্যামিতি স্যারের কথা মনে হলেই স্যারের পিটুনির কথা মনে হয়। কাজেই এই নাম আমরা রাখতে পারব না।” কথা শেষ করে টিটন টেবিলে একটা কিল দিল আর তখন টেবিলের সব প্লেট-পিরিচ ঝনঝন করে উঠল।
টিটনের এতো জোরে কিল দেওয়ার কোনো দরকার ছিল না। তার যুক্তিটা কিল ছাড়াই আমরা মেনে নিতাম। যে ক্লাবের নাম শুনলেই পিটুনির কথা মনে হয়
সেই নাম রাখা ঠিক না। অনু তখন বলল, “তা হলে নাম রাখি অটিরাচ।”
“অটিরাচ?” চঞ্চল বলল, “অটিজম আছে জানি, কিন্তু অটিরাচ আবার কী?”
অনু হাসি হাসি মুখে বলল, “সেটাও বুঝলি না? অনুর অ টিটনের টি রাতুলের রা আর চঞ্চলের চ দিয়ে অটিরাচ!”
আমরা সবাই দুলে দুলে হাসলাম, নামটা ভালোই কিন্তু চঞ্চল আপত্তি করল, বলল, “আমাদের ক্লাবে আমরা কি আর কাউকে নিব না? ধর আরেকজন এলো, তার নাম ঝন্টু তখন ক্লাবের নাম হয়ে যাবে অটিরাচঝ। তারপর আরেকজন, তার নাম শওকত তখন ক্লাবের নাম হবে অটিরাচঝশ–উচ্চারণ করতেই দাঁত ভেঙে যাবে। তারপর যখন ক্লাবের মেম্বার হবে একশজন তখন সেই নাম আর কেউ মনে রাখতে পারবে না!”
চঞ্চলের কথায় যুক্তি আছে তাই অটিরাচ নামটাও বাতিল হয়ে গেল। টিটন তখন নতুন উৎসাহে বলল, “তা হলে নামটা ব্লাড অ্যান্ড মার্ডারই রেখে দিই। একেবারে ফাটাফাটি নাম। কী বলিস?”
চঞ্চল বলল, “উঁহু, আমার পছন্দের নাম হচ্ছে অয়লার।”