ম্যাজিস্ট্রেট বলল, “রি-রি-রিভলবার?”
টুনি মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ। আরেকজন যে আছে সে ভোটকা। তার হাত-পাগুলো থাম্বার মতো। তার কোনো অস্ত্র লাগে না-খালি হাতে চাপ দিয়ে
যে কোনো মানুষের মাথা পুটুস করে ভেঙে দিতে পারে।”
ম্যাজিস্ট্রেট ভদ্রলোক থতমত খেয়ে বললেন, “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ঐ রকম ডেঞ্জারাস মানুষ এখানে কী করছে? তোমরা কী করছ? তাদের রিভলবার তোমার হাতে কেন?”
টুনি বলল, “সেটা অনেক লম্বা স্টোরি।”
“ডেঞ্জারাস মানুষগুলো এখন কোথায়?”
“শুয়ে আছে।”
“শুয়ে আছে? শুয়ে আছে কেন?”
আমি বললাম, “আমরা বেঁধে রেখেছি। সেই জন্যে শুয়ে আছে।”
“তোমরা ছোট ছোট বাচ্চারা এরকম মানুষকে কেমন করে বেঁধে রাখলে?”
এবারে আমরা সবাই একসাথে বললাম, “সেটা অনেক লম্বা স্টোরি।” বলেই আমরা হি হি করে হাসতে লাগলাম। কেন হাসছি বুঝতে পারছি না, কিন্তু কিছুতেই হাসি থামাতে পারি না। কী মুশকিল!
ম্যাজিস্ট্রেট মানুষটা আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। চঞ্চল চাবি দুটি ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে দিয়ে বলল, “ভিতরে একটা ঘরের আর সিন্দুকের চাবি। ঐ ঘরেই আমরা মানুষ দুইটাকে তালা মেরে রেখেছি। মানুষগুলো নিশ্চয়ই এতক্ষণে অনেক ভয় পাচ্ছে।”
“কেন ভয় পাবে কেন?”
“সিন্দুকের উপর ছোট একটা মেয়ের কঙ্কাল।”
ম্যাজিস্ট্রেট চমকে উঠে চিৎকার করে বলল, “কঙ্কাল?”
“হ্যাঁ। মোমবাতি শেষ হয়ে গেলে যখন ঘরটা অন্ধকার হয়ে যাবে তখন মানুষ দুইটা অনেক ভয় পাবে মনে হয়।”
অনু বলল, “সিন্দুকের ভিতরে না কী অনেক সোনাদানা। কিন্তু সাবধান। মেয়েটা যক্ষ হয়ে সেই সোনাদানা পাহারা দিচ্ছে!”
ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে যে আরেকজন মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি এতক্ষণ একটা কথাও বলেননি, আমাদের কথা শুনছিলেন। এবারে ম্যাজিস্ট্রেট ভদ্রলোককে বললেন, “বিল্ডিং ডেমোলিশান আপাতত বন্ধ রাখি। কি বলেন?”
“হ্যাঁ। এরা যদি সত্যিই সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্ক পেয়ে থাকে তা হলে সেটা একটা ঐতিহাসিক জিনিস হবে। মানুষ টিকিট কেটে দেখতে আসবে।–”
আমরা তখন ব্যাগগুলো ঘাড়ে নিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম। অনু তার কবুতরটা ছেড়ে দিল, সেটা ডানা ঝাঁপটিয়ে আকাশে উড়ে গেল। আমরা সেটার দিকে হাত নাড়িয়ে যখন হাঁটতে শুরু করেছি তখন ম্যাজিস্ট্রেট ভদ্রলোক বললেন, “দাঁড়াও দাঁড়াও! তোমরা কোথায় যাচ্ছ? তোমাদের সাথে আমাদের কথা শেষ হয় নাই।”
মিথিলা বলল, “কিন্তু এখন আমাদের বাসায় যেতে হবে। না হলে আম্মু চিন্তা করবে।”
“তা হলে তোমাদের বাসা কোথায় বল। তোমাদের নাম-ঠিকানা-টেলিফোন নম্বর—
.
বাসায় আসতে একটু দেরি হল। টেবিলে খাবার দিতে দিতে আম্মু বললেন, “স্কুল ছুটির জন্যে তোদের খেলা মনে হয় একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে। ধুলাবালি মেখে চেহারা কী রকম সংয়ের মতো হয়েছে দেখেছিস? খেলা একটু কমা।”
মিথিলা বলল, “আম্মু আসলে এটা খেলা না।”
আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “এটা তা হলে কী?”
“সেটা অনেক লম্বা স্টোরি!”
বলে আমি আর মিথিলা দুজনেই হি হি করে হাসতে থাকি।
.
১০.
১০ সুড়ঙ্গের ভিতরের সেই ঘর থেকে মানিক আর তার ওস্তাদকে পুলিশ সেদিনই ধরে এনেছিল। দুজনেই না কী ঘাগু আসামি, দুজনের নামেই অনেক কেস। পুলিশ না কী অনেকদিন থেকে তাদের খুঁজছে।
সিন্দুকের উপর যে কঙ্কালটা ছিল সেটাকে সপ্তাহখানেক পরে কফিনে ভরে এনে জানাজা পড়িয়ে কবরস্থানে কবর দিয়েছে। পুরো খবরটা খবরের কাগজে ও টেলিভিশনে বের হয়েছিল তাই জানাজায় অনেক মানুষ হয়েছিল। কবরটা বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে, মাথার কাছে লেখা আছে, “নাম পরিচয়হীন একটি দুঃখী বালিকা। মানুষের লোভ আর অবহেলায় শিকার। জন্ম-মৃত্যুর তারিখ অজানা।”
মিশকাত মঞ্জিল ভাঙা আপাতত বন্ধ আছে। মামলা করে যে জিতেছে সে না কী দোটানায় পড়ে গেছে। লোকজন তাকে বলছে মার্কেট করে সে যত টাকা আয় করবে তার থেকে বেশি আয় করবে পাবলিকদের সুড়ঙ্গ দেখিয়ে। সেখানে সুড়ঙ্গের ভিতর সিন্দুকটা আছে। ভেতরের সোনাদানা পুলিশের কাছে, সোনার অলংকারের মাঝে না কী রক্তের শুকনো দাগ। সোনাদানা কে পাবে সেটা এখনো পরিষ্কার হয়নি, শোনা যাচ্ছে জাদুঘরে দিয়ে দেওয়া হবে।
সেদিন মিশকাত মঞ্জিলের নিচে কী হয়েছিল সেটা জানার পর আমাদের আব্বু-আম্মুরা প্রথমে আমাদের উপর খুব রাগ করেছিল। প্রথম প্রথম হম্বিতম্বি করে বলেছে আমাদেরকে আর কখনো ঘর থেকেই বের হতে দেবে না। কিন্তু এরকম অসাধারণ একটা সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্ক বের করেছি, যক্ষ বের করেছি, যক্ষের ধন বের করেছি, শুটকা মানিক আর তার ভোটকা ওস্তাদকে আটক করেছি কাজেই তারা খুব বেশি দিন রাগ ধরে রাখতে পারেনি।
তবে আমাদের নিজেদের ভিতরে অনেক রাগারাগি হচ্ছে। টিটন রেগেছে চঞ্চলের ওপরে তার তাবিজের ভেতর ই ইকুয়েন্স টু এম সি স্কয়ার লিখে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্যে। অন্যেরা রেগেছে আমার উপর, আমি চোট্টামি করে লটারিতে সবাইকে ঠকিয়ে ব্ল্যাক ড্রাগন নামটা করে দিয়েছি সেই জন্যে। ভুলটা আমারই, গল্পের ফাঁকে একদিন নিজেই বলে দিয়েছিলাম-না বললেই হত। সবাই রেগে মেগে বলছে আবার নতুন করে ক্লাবের নাম দেওয়া হবে।
কিন্তু নতুন করে নাম দেওয়া মনে হয় সহজ হবে না। রেডিও-টেলিভিশনেও এই নামটার কথা বলা হয়ে গেছে! সবাই এখন এই নামটার কথা জানে! সবাই এখন এর মেম্বার হতে চায়–বিশেষ করে ছোট বাচ্চারা। তারা পুরো ঘটনাটা শুনে মহা উত্তেজিত। দিনরাত আমাদের পিছনে পিছনে ঘোরে পরের অ্যাডভেঞ্চারে তাদের নেওয়ার জন্যে।