চুপচাপ বসে থাকা খুব কঠিন। আমরা যদি পুরোপুরি নিশ্চিত হতাম যে আসলেই গুইসাপটা ফিরে আসবে তা হলে অপেক্ষা করা অনেক সহজ হত। কিন্তু যেহেতু আমরা জানি না তাই বুঝতে পারছি না চুপচাপ বসে থেকে আমরা শুধু শুধু সময় নষ্ট করছি কি না।
অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর টিটন ফিসফিস করে বলল, “মনে হয় আর আসবে না।”
অনু বলল, “আমারও মনে হয় আসবে না। সময় কাটছে না, আয় বাকি স্যান্ডউইচগুলো খাই।”
আমি অনুকে ধমক দিয়ে বললাম, “সারাক্ষণ খালি খাই খাই করবি না।”
টুনি বলল, “আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। তারপরেও যদি না আসে তা হলে আমরা নিজেরাই খোঁজা শুরু করব।”
আমি বললাম, “ঠিক আছে।”
বসে থাকতে থাকতে আমার মনে হয় চোখে একটু ঘুমের মতো চলে এসেছিল, হঠাৎ শুনলাম টুনি ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, “স-স-স-স…”
সাথে সাথে আমি পুরোপুরি জেগে উঠলাম। তাকিয়ে দেখলাম একটু দূর থেকে ছায়ার মতো কিছু একটা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। ছায়াটা আস্তে আস্তে একটু স্পষ্ট হল। আমরা দেখলাম বেশ বড়সড়ো গোবদা সাইজের একটা গুইসাপ-একটু আগে এটাকেই আমি আর টুনি দেখেছিলাম। আমরা নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকি তখন দেখলাম পিছন থেকে আরো একটা গুইসাপ আসছে–এটা আগেরটা থেকে সাইজে একটু ছোট। অনু ফিসফিস করে বলল, “একা আসে নাই। গার্ল ফ্রেন্ডকে নিয়ে এসেছে।”
টুনি হাসি চেপে বলল, “হ্যাঁ।”
আমি বললাম, “চল এখন ধাওয়া দিই।”
চঞ্চল বলল, “চল।”
“দুইটা যদি দুই দিকে যায়?”
“তা হলে আমরাও দুই দলে ভাগ হয়ে যাব।”
আমরা মাথা নাড়লাম, বললাম, “ঠিক আছে।”
চঞ্চল তখন তার টর্চ লাইটটা জ্বালিয়ে সেটা গুইসাপের উপর ফেলল। টর্চ লাইটের তীব্র আলোতে গুইসাপটা মনে হয় একটু হকচকিয়ে গেল, তারপর ঘুরে গিয়ে সেটা থপ থপ করে দৌড়াতে শুরু করে। পিছনের গার্ল ফ্রেন্ড গুইসাপটাও ঘুরে যায়–সেটাও ছুটতে থাকে। আমরা হইহই করে তখন গুইসাপ দুইটাকে তাড়া করি।
গুইসাপ দুটি প্রথমে সোজা সামনের দিকে গেল তারপর ডান দিকে ঘুরে গেল তারপর আবার সোজা আবার ডান দিকে। তারপর এক জায়গায় এসে হঠাৎ করে বাম দিকে ঘুরে লাফিয়ে উঠল। দেখলাম হাচড়-পাঁচড় করে কোথায় জানি ঢুকে এবং অদৃশ্য হয়ে গেল। প্রথমে ছোট গুইসাপটা তারপরে বড় গুইসাপটা। গুইসাপটার পিছু পিছু আমরা সেই জায়গাটাতে হাজির হলাম, দেখলাম দেয়ালে ছোট একটা গর্ত এই গর্ত দিয়েই গুইসাপ দুটি বের হয়ে গেছে।
আমরা জায়গাটা ভালো করে লক্ষ করলাম, চঞ্চল দেয়ালটাতে হাত বুলিয়ে কী যেন দেখে চমকে উঠে বলল, “কী আশ্চর্য!”
“কী হয়েছে?”
“এটা একটা গেট!”
“গেট?”
“হ্যাঁ। এই দেখ। মাটি আর শ্যাওলা পড়ে পড়ে ঢেকে গেছে। কিন্তু আসলে এটা কাঠের গেট। কাঠ পচে ছোট গর্ত হয়েছে।”
আমরা এসে পরীক্ষা করে দেখি চঞ্চল ঠিকই বলেছে। সত্যিই এটা একটা গেট! মাটি, শ্যাওলা সরিয়ে আমরা গেটের কড়াগুলো খুঁজে পেলাম, সেখানে একটা জংধরা তালা ঝুলছে। টুনি বলল, “মিথিলা, এইটার চাবি কী তোর কাছে আছে?”
মিথিলা বলল, “না টুনি আপু। নাই।”
আমি বললাম, “না থাকলেও ক্ষতি নাই। এই তালাটা জং ধরে একেবারে ক্ষয়ে গেছে। শাবল দিয়ে জোরে দুইটা বাড়ি দিলে ভেঙে যাবে।”
“চল, তা হলে শাবলটা নিয়ে আসি।”
“শুধু শাবল না–আমাদের ব্যাগগুলোও নিয়ে আসি। মনে হয় এদিক দিয়ে বের হওয়া যাবে।”
টুনি বলল, “সবার যাওয়ার দরকার নাই। দুইজন এখানে থাক। অন্যরা যাই।”
টুনি আর মিথিলাকে রেখে আমরা আমাদের ব্যাগ আর শাবল নিয়ে ফিরে এলাম। শাবলটা দিয়ে তালাটায় জোরে একটা ঘা দিতেই সেটা খুলে গেল। গেটটা বহু বছর খোলা হয়নি তাই সেটা খুলতে চাইল না। আমরা শাবল দিয়ে চাপ দিয়ে কষ্ট করে পাল্লাগুলো একটু ফাঁক করলাম। ঘরটায় মাটি-শাবল দিয়ে সেখানে কয়েকটা ঘা দিতেই মাটির চাঙর ভেঙে ভেঙে পড়ল, আর আমরা বাইরের আলো দেখতে পেলাম, সাথে সাথে সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠি! আমরা সত্যি সত্যি বের হয়ে আসতে পেরেছি।
শাবল দিয়ে মাটিগুলো সরিয়ে আমরা একজন একজন করে বের হয়ে আসি, বাইরে সূর্যের আলোতে আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে গেল বলে প্রথম কয়েক সেকেন্ড আমরা কিছু দেখতে পারলাম না। একটু পরে যখন চোখ সয়ে এলো তখন আমরা
অবাক হয়ে দেখলাম দুজন বয়স্ক মানুষ আরো বেশি অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। একজন তোতলাতে তোতলাতে বলল, “তোমরা এখানে কোথা থেকে বের হয়ে এসেছ?”
টুনি বলল, “সেটা অনেক লম্বা স্টোরি।”
বয়স্ক মানুষটা বলল, “জনশ্রুতি আছে এই মিশকাত মঞ্জিলের নিচে সুড়ঙ্গের একটা নেটওয়ার্ক আছে। ডাকাতেরা ডাকাতি করে এই সুড়ঙ্গ দিয়ে মিশকাত খানের সাথে দেখা করত। তোমরা কী বাই এনি চান্স সেই সুড়ঙ্গটা খুঁজে পেয়েছ?”
আমি বললাম, “আমরা আরো অনেক কিছু খুঁজে পেয়েছি।”
মানুষটা চমকে উঠল, বলল, “যক্ষের ধন?”
টুনি বলল, “তার থেকেও বেশি।”
“তার থেকে বেশি কী?”
“সেটা মনে হয় পুলিশকে বলতে হবে।”
“আমাকে বল, পুলিশকে আমিই জানাতে পারব। আমি একজন ম্যাজিস্ট্রেট। প্রপার্টি হ্যাঁন্ড ওভারের জন্যে সরকারি কাজে এসেছি।”
টুনি বলল, “দুইজন মানুষ। একজন ভোটকা একজন শুটকা।”
চঞ্চল ব্যাগ থেকে মানিকের রিভলবারটা বের করে বলল, “এই যে এটা শুটকা মানুষের রিভলবার। তার নাম মানিক, ডাকে মাইনকা।”