টিটন আর আমি দুজনেই মাথা নাড়লাম, বললাম, “হ্যাঁ। খুব ভালো করে কাটাতে হবে।” ছুটিতে আমরা কী কী করব সেটা চিন্তা করে আমাদের মুখে বিশাল একটা হাসি ফুটে উঠল আমরা তখন পা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসলাম।
চঞ্চল একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, “ভালো করে কাটানো মানে—”
টিটন বলল, “ফূর্তি ফূর্তি ফূর্তি!”
চঞ্চল বলল, “না মানে ইয়ে-”
আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, “কীয়ে?”
“এই ধর, মানে আমরা যদি একটা সায়েন্স ক্লাব করি।”
টিটন হাতে কিল দিয়ে বলল, “ঠিক বলেছিস! আমাদের একটা ক্লাব করতে হবে। আমরা সবাই হব মেম্বার এবং আমরা মেম্বাররা এই পাড়াটাকে পাহারা দেব। বাইরে থেকে কেউ এলে পিটিয়ে তক্তা করে দেব।”
চঞ্চল ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি পিটাপিটির ক্লাবের কথা বলি নাই। আমি বলেছি সায়েন্স ক্লাব। আমরা সায়েন্স প্রজেক্ট করব। কোনো
একটা জিনিস আবিষ্কার করব।”
টিটনকে সায়েন্স নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত মনে হল না। সে বলল, “ডিটেকটিভ ক্লাব করতে পারি। কেউ মার্ডার হলে আমরা খুঁজে বের করে ফেলব।”
আমি বললাম, “যদি কেউ মার্ডার না হয়?”
টিটন মাথা চুলকে বলল, “তা হলে অন্য কোনো অপরাধ। চুরি, ডাকাতি।”
“সেগুলোও যদি না হয়?”
“তা হলে আমরা নিজেরাই করে ফেলব।”
“ধুর!” আমি বললাম, “তার থেকে আমরা খেলাধুলার ক্লাব করতে পারি। বোম্বাস্টিক না হলে ফুটবল-ক্রিকেট ক্লাব।”
টিটন বলল, “তিনজনে ফুটবল ক্লাব হয় না। কমপক্ষে এগারোজন লাগে।”
“তিনজন দিয়ে শুরু করব, তারপর আস্তে আস্তে বাড়বে।”
চঞ্চল বলল, “সায়েন্স ক্লাব বানালে তিনজন দিয়েই শুরু করা যায়।”
টিটন রেগে গিয়ে বলল, “সায়েন্স ক্লাব একজনকে দিয়েই হয়।”
চঞ্চল গম্ভীর হয়ে বলল, “একজনের কোনো ক্লাব হয় না। ক্লাব মানেই হচ্ছে। একজন থেকে বেশি।”
আমি বললাম, “শুধু আমরা তিনজন কে বলেছে? অনু আছে না?”
তখন টিটন আর চঞ্চল মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। হ্যাঁ। অনুও আছে।”
অনুর নামটাও ভুল নাম। অণু পরমাণু মানেই ছোট ছোট বিন্দু বিন্দু জিনিস, কিন্তু আমাদের অনু মোটাসোটা নাদুস-নুদুস গোলগাল। মোটাসোটা মানুষ সবসময় হাসি-খুশি হয় তাই অনুও হাসি-খুশি। চঞ্চল যেরকম আমাদের বৈজ্ঞানিক অনু সেরকম আমাদের কবি। দুনিয়ার যত বই সে পড়ে ফেলেছে। বড়দের জন্যে লেখা অসভ্য অসভ্য বই, যেগুলো আমাদের হাতে নেওয়া মানা অনু সেগুলোও পড়ে ফেলেছে। তাদের বাসা ভর্তি বই, সবাই সারাক্ষণ বসে বসে বই পড়ে। টিটন বলেছে একদিন সে না কি অনুদের বাসায় গিয়েছে তখন সে দেখে অনুদের বাসার একটা বিড়াল একটা ভোলা বইয়ের সামনে বসে বসে বই পড়ছে। টিটনের বেশিরভাগ কথা আমরা অবশ্যি বিশ্বাস করি না, কিন্তু এই কথাটা সত্যি হতেও পারে। অনুদের বাসার বিড়াল বই পড়লে অবাক হবার কিছুই নেই।
চঞ্চল বলল, “আজকে ছুটির দিনে অনু ঘরের ভিতরে বসে বসে কী করছে? বের হয় না কেন?”
আমি বললাম, “নিশ্চয়ই রাত দুইটা পর্যন্ত বই পড়ে এখন ঘুমিয়ে আছে।”
“চল গিয়ে ডেকে তুলি।”
“চল।” বলে আমরা গাছ থেকে নামতে শুরু করলাম। সাধারণত আমরা কাউকে ঘুম থেকে ডেকে তুলি না, কিন্তু অনুদের বাসার কথা আলাদা। তাদের বাসাটা অন্যরকম, আমরা গেলে মনেই হয় না আমরা অন্য কারো বাসায় গেছি। বাসার সবগুলো মানুষ হাসি-খুশি সবচেয়ে বড় কথা অনু যে নাদুস-নুদুস মোটাসোটা তার একটা কারণ আছে। এমনি এমনি কেউ নাদুস-নুদুস মোটাসোটা হয় না–সেটা হবার জন্যে ভালো-মন্দ খেতে হয়। অনুদের বাসায় খাওয়া-দাওয়া খুবই ভালো। আমরা যখনই যাই তখনই দেখি তারা মজার মজার খাবার খাচ্ছে। আমাদেরকে ডাকাডাকি করে বসিয়ে দেয় আর আমরাও গাপুস-গুপুস করে খাই। টিটন যে অনুকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার কথা বলেছে সেটা শুধু অনুর সাথে কথা বলার জন্যে না, অনুর আম্মু যেসব মজার মজার নাস্তা তৈরি করে রেখেছেন আর আমরা গেলেই যেগুলো আদর-যত্ন করে খাওয়াবেন সেটার জন্যেও। আমার মনে হয় সেইটাই আসল কারণ।
আমরা হেঁটে হেঁটে যেতে থাকি। পাশাপাশি অনেকগুলো বাসা–অনুদের বাসা একটু দূরে, সামনে একটা খোলা মাঠ, আমরা মাঠের মাঝখান দিয়ে যখন শর্টকাট মারছি তখন মিঠুদের বাসাটা চোখে পড়ল। মিঠু ছিল আমাদের প্রাণের বন্ধু, তিন মাস আগে তার আবু বদলি হয়ে কক্সবাজার চলে গেছেন। যাবার সময় মিঠু রীতিমতো আমাদের ধরে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল। কক্সবাজার পোঁছে আমাদের বিশাল লম্বা একটা চিঠি দিয়েছে, তার মাঝে সমুদ্রের নানারকম বর্ণনা। আমাদের ছেড়ে একা একা থাকতে তার কত কষ্ট হয়েছে সেটাও লিখেছে। আমরা ভাবলাম চিঠির একটা লম্বা উত্তর দিব। টিটন বলল, তার চাইতে টেলিফোনে কথা বলি। চঞ্চল বলল, সবচেয়ে ভালো হয় ই-মেইল পাঠালে। লাভের মাঝে লাভ হল কোনোটাই করা হল না। এখন আমরা তার ঠিকানাও হারিয়ে ফেলেছি, টেলিফোন নম্বরও জানি না। বেচারা মিঠু নিশ্চয়ই ভাবছে আমরা তাকে ভুলে গেছি, আসলে মোটেও ভুলিনি, যতবার এই মাঠের মাঝখান দিয়ে শর্টকাট মারি আর মিঠুদের বাসাটা চোখে পড়ে ততবার তার কথা মনে পড়ে আর আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
অনুদের বাসায় গিয়ে দরজা ধাক্কা দিতেই অনুর আম্মু দরজা খুলে দিলেন। আমাদের দেখে হাসি হাসি মুখে বললেন, “কী খবর, ত্রিরত্ন? চতুর্থ রত্নের খোঁজে?”