টুনি কিছু না বলে এক আঙুল দিয়ে মানিককে নিজের দিকে ডাকে। মানুষ পথে-ঘাটে কুকুর কিংবা বিড়ালের বাচ্চাকে যেভাবে ডাকে, অনেকটা সে রকম। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম টুনির সারা শরীর ইস্পাতের তারের মতো টান টান হয়ে গেছে, সে তার দুই পায়ের উপর ভর দিয়ে নাচের ভঙ্গি করে দুলতে থাকে।
মানিক এবারে মিথিলাকে ছেড়ে দেয় তারপর রিভলবারটা টুনির দিকে তাক করে এগিয়ে আসে। হঠাৎ করে মনে হল ঘরের মাঝে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। আমরা দেখলাম টুনি ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়, তার পা শূন্যে উড়ে যায়, আমরা কিছু বোঝার আগে দেখলাম টুনি তার পা দিয়ে মানিকের মুখের মাঝে প্রচণ্ড জোরে লাথি মেরে বসেছে। একজন মানুষের পা যে এত উপরে উঠতে পারে সেটা নিজের চোখে না দেখলে আমরা বিশ্বাস করতাম না। মানিক একটা আর্ত চিৎকার করে ঘুরে পড়ে যায়। সে এখনো বুঝতে পারছে না কী হয়েছে। আমরা মানিকের দিকে ছুটে যাচ্ছিলাম তখন টুনি চিৎকার করে আমাদের থামাল, বলল, “তোরা সব যা।”
বিড়াল যেভাবে ইঁদুরের বাচ্চা ঘিরে ঘুরতে থাকে, টুনি এখন ঠিক সেভাবে মানিককে ঘিরে ঘুরতে থাকে। মানিক তার রিভলবারটা তুলে ধরে, আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি সে এখন গুলি করে বসবে কিন্তু তার আগেই টুনি বিদ্যুৎ চমকানোর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, আমরা দেখতে পেলাম তার একটা লাথিতে হাত থেকে রিভলবারটা উড়ে গিয়ে নিচে পড়েছে। টিটন তখন ছুটে গিয়ে রিভলবারটা নিজের হাতে তুলে নিল।
টুনি নাচের ভঙ্গিতে মানিককে ঘিরে ঘুরতে ঘুরতে বলল, “মানিকের বাচ্চা মানিক সাহেব, দুই হাত পিছনে নিয়ে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ন তা না হলে আপনার দুটি দাঁত এক্ষুনি খুলে যাবে। আমি ফোর্থ ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্ট। আমাকে দেখে মনে না হতে পারে কিন্তু খালি হাতে আমি আপনার মতো দুই-চারজনকে খুন করে ফেলতে পারি।”
মানিক টুনির কথা বিশ্বাস না করে দুর্বলভাবে ওঠার চেষ্টা করল, আর সাথে সাথে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো টুনি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, আমি দেখলাম সাথে সাথে মানিক হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল, আর ওঠার সাহস পেল না।
টিটন তখন রিভলবারটা তুলে পাহাড়ের মতো মানুষটার দিকে তাক করে ধরেছে, চিৎকার করে বলছে, “হ্যান্ডস আপ।”
পাহাড়ের মতো মানুষটার মুখ দেখে মনে হল সে এখনো পুরো ব্যাপারটা বিশ্বাস করছে না। সে অবাক হয়ে একবার টুনির দিকে আর একবার টিটনের দিকে তাকাল, তারপর বলল, “কী বললি? হ্যাঁন্ডস আপ? এই বান্দরের বাচ্চা তুই হ্যাঁন্ডস আপ মানে জানিস?”
টিটন কোনো কথা না বলে রিভলবারটা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। পাহাড়ের মতো মানুষটা তখন টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই নিজেকে কী ভাবিস? ফিল্ম স্টার? মাইনকা হচ্ছে মাজাভাঙা টিবি রোগী! তার সাথে মাইরপিট করে তোর সাহস বেড়েছে? আয় তা হলে আমার কাছে–তোর ফিলমি কায়দা আমার সাথে কর! তোর কলজে যদি আমি ছিঁড়ে না ফেলি তা হলে আমি বাপের ব্যাটা না।”
টিটন বলল, “হ্যান্ডস আপ। যদি আপনি হ্যাঁন্ডস আপ না করেন গুলি করে দিব।”
মানুষটা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “তুই গুলি কর! দেখি তোর গুলি আমার চামড়া ফুটা করতে পারে কি না। কর গুলি।”
টিটন গুলি করল না, শুধু চিৎকার করে বলল, “হ্যান্ডস আপ। না হলে গুলি করে দিব।”
মানুষটা হঠাৎ এগিয়ে এসে খপ করে টিটনের হাতটা ধরে রিভলবারটা কেড়ে নিয়ে বলল, “এই ছেমড়া, তোর রিভলবারকে আমি ভয় পাই?” মানুষটা রিভলবারটাকে তার কোমরে গুঁজে বলল, “আমার সাথে রংবাজি? আমি সবগুলোকে এখন খুন করে ফেলব। খালি হাতে আমি তোদের মুণ্ডু ছিঁড়ে ফেলব।”
পাহাড়ের মতো মানুষটা টিটনের চুল ধরে তাকে হ্যাঁচকা টানে নিজের কাছে টেনে আনে, মনে হয় সত্যিই বুঝি টিটনের মাথাটা ছিঁড়ে ফেলবে। ঠিক তখন চঞ্চল বলল, “ভালো হবে না কিন্তু, ছেড়ে দেন, ছেড়ে দেন ওকে।”
মানুষটা চঞ্চলের গলার স্বর শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “কে কথা বলে?”
চঞ্চল বলল, “আমি।”
মানুষটা বলল, “আমি তাই ভেবেছিলাম। তুই না হলে এতো বেশি কথা আর কে বলবে? তোরে না আমি না করেছি বেশি কথা না বলার জন্যে। আমার কথা কানে যায় না?”
চঞ্চল ঠাণ্ডা গলায় বলল, “আপনি ওকে ছেড়ে দেন।”
পাহাড়ের মতো মানুষটা টিটনকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে ছেড়ে দিলাম। তোরে ধরলে তোর কোনো আপত্তি আছে?”
চঞ্চল বলল, “না, নাই।”
“ফড়িংয়ের বাচ্চা ফড়িং তোর সাহস তো কম না।” মানুষটা দাঁত কিড়মিড় করে চঞ্চলের দিকে এগিয়ে আসে। চঞ্চল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কাছে আসতেই সে খপ করে মানুষটাকে দুই হাতে তাকে ধরল সাথে সাথে আমরা দেখতে পেলাম মানুষটা বিকট আর্তনাদ করে ছিটকে পড়ল। তার দুই চোখে অবিশ্বাস, কী ঘটেছে সে কিছু বুঝতে পারছে না।
চঞ্চল দুই হাত সামনে বাড়িয়ে মানুষটার দিকে এগিয়ে যায় আর মানুষটা ভয়ে-আতঙ্কে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। চঞ্চল আবার দুই হাতে তাকে ধরে ফেলল, আর আমরা অবাক হয়ে দেখলাম এতো বড় মানুষটার সারা শরীর ঝাঁকুনি খেতে থাকে, মানুষটা থরথর করে কাঁপছে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তার চোখ উল্টে গেল, মুখ হাঁ হয়ে গেল, তখন চঞ্চল তাকে ছেড়ে দিল আর সে দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ল, মনে হল বিশাল একটা কোলা ব্যাঙ বুঝি লাফ দিয়েছে।