মানুষটার কথা শুনে আমার বুকটা কেঁপে উঠল, কী ভয়ানক কথা বলছে। আমাদের এখানে আটকে রাখবে! আমি মিথিলার দিকে তাকালাম, ভেবেছিলাম দেখব ভয়ে তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, কিন্তু ঠিক কী কারণ জানা নেই, তাকে দেখে মনে হল না সে খুব ভয় পেয়েছে। সে টুনির হাত ধরে রেখে শান্ত মুখে মানুষগুলোকে দেখছে।
মানিক আমাদের দিকে রিভলবারটা ধরে রাখল, আর তার পাহাড়ের মতো ওস্তাদ লোহার শাবলটা ঘাড়ে নিয়ে সিন্দুকটা ঘুরে একটা চক্কর দেয়। তারপর মুখ দিয়ে লোল টানার মতো শব্দ করে বলল, “আমার আর সহ্য হচ্ছে না। সিন্দুকটা খুলি। মাইনকা টর্চ লাইটটা এদিকে ধর।–”
চঞ্চল বলল, “আমাদের কাছে মোমবাতি আছে। লাগবে আপনাদের?”
“মোমবাতি?” পাহাড়ের মতো মানুষটার মুখে হাসি ফুটে উঠল, বলল, “আগে বলবি তো? টর্চ লাইট ধরে কী কাজ করা যায়? বার কর মোমবাতি।”
চঞ্চল কেন গায়ে পড়ে মানুষগুলোকে সাহায্য করতে চাইছে অন্য কেউ সেটা বুঝতে পারল না, শুধু আমি বুঝতে পারলাম। সে তার ইনডাকশন কয়েলটা বের করতে চাইছে।
মানিক রিভলবারটা চঞ্চলের দিকে তাক করে রেখে বলল, “খবরদার কোনো রকম রং তামাশা করবি না। ভদ্রলোকের মতো মোমবাতিটা বের করবি।”
চঞ্চল তার ব্যাগ থেকে মোমবাতি বের করার ভান করে অনেক কিছু বের করল, তার ইনডাকশন কয়েলটাও। সেখান থেকে মোমবাতিগুলো আলাদা করে মানিকের হাতে দেয়, তারপর বের করা জিনিসগুলো আবার ব্যাগের ভেতর ঢোকাতে থাকে। আমি চোখের কোনা দিয়ে লক্ষ করলাম সে অন্য জিনিসগুলো ব্যাগে ঢোকালেও ইনডাকশন কয়েলটা ঢোকালো না। আমি তখন চঞ্চলকে সাহায্য করার জন্যে মানিকের দৃষ্টি ফেরানোর চেষ্টা করলাম। তার দিকে তাকিয়ে বললাম, “আপনারা তো সিন্দুক খুলে সোনাদানা পাবেন। আমরা কি এখন যেতে পারি?”
মানিক অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী বললি?”
“বলছি যে আমরা কি এখন যেতে পারি?”
“কোথায় যাবি?”
“বাসায়।”
“বাসায়?” আমার কথা শুনে মানিক এতো অবাক হল যে বলার মতো নয়। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলল, “তোর মাথায় কী গোবর না কী অন্য কিছু? তুই কেমন করে ভাবলি যে আমরা তোদের ছেড়ে দিব? তোদেরকে ছেড়ে দিলে তোরা যে বাইরে গিয়ে খবর দিবি আর পুলিশ, র্যাব, মিলিটারি এসে আমাদেরকে ধরবে সেটা তোর মোটা মাথায় ঢুকে না?”
অবশ্যই ঢুকে কিন্তু আমি যে তার দৃষ্টি আমার দিকে রাখার জন্যে কথাগুলো বলছি সেটা তো আর বলতে পারছি না। তাই আমি আলাপ চালিয়ে যাবার জন্যে বললাম, “ঠিক আছে তা হলে আমাদেরকে সোনাদানার একটু ভাগ দেন তা হলে আমরা কাউকে বলব না।”
“কী বললি?” মানিক আমার কথা শুনে এবারে শুধু অবাক নয় মনে হয় রেগেও গেল। বলল, “তোদের সোনাদানার ভাগ দিব?”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “কেন দিবেন না? আমরাই তো এই জায়গাটা খুঁজে বের করেছি।”
মানিক তখন পাহাড়ের মতো মানুষটার কাছে নালিশ করল, বলল, “শুনছেন ওস্তাদ এই পোলা কী বলে? তারে না কি সোনাদানার ভাগ দিতে হবে।”
“এদের কথা শুনিস না মাইনকা। এরা মেলা তাঁদর। এদের কথা শুনলে কানের পোকা নড়ে যায়।”
এতক্ষণে চঞ্চল নিশ্চয়ই ইনডাকশন কয়েলটা তার হাতে লাগিয়ে ফেলেছে আমি তাই আর কথা বললাম না। পাহাড়ের মতো মানুষটা মোমবাতিগুলো ঘরের এদিক-সেদিক রেখে সেগুলো জ্বালিয়ে দেয়। সাথে সাথে ঘরের ভিতর একটা নরম আলো ছড়িয়ে পড়ে। টর্চ লাইটটা নিভিয়ে পাহাড়ের মতো মানুষটা আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই সিন্দুকের চাবি কার কাছে?” টিটন তার হাতের চাবিটা
এগিয়ে ধরে, মোটা মানুষটা এসে ছোঁ মেরে চাবিটা নিয়ে নেয়।
পাহাড়ের মতো মানুষটা বলল, “এখন আমি এই সিন্দুকের তালা খুলব। তোরা কোনো গোলমাল করবি না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক। চোরের গুষ্টি চোর।”
আমার কেমন জানি রাগ উঠে গেল, বললাম, “চুরি করতে এসেছেন আপনারা, আর আমাদেরকে বলছেন চোর?”
মানিক তখন হঠাৎ যেন খেপে গেল, চোখ পাকিয়ে বলল, “কী বললি? কী বললি তুই? আমরা চুরি করতে এসেছি? তোর এতো বড় সাহস, তুই আমাদের চোর ডাকিস?” মানিক রাগে দাঁত কিড়মিড় করে রিভলবারটা আমার মাথার দিকে তাক করে, আমি দেখতে পেলাম সে রিভলবারের ট্রিগারটা টেনে ধরেছে, যে কোনো মুহূর্তে একটা গুলি বের হয়ে আসবে।
তখন অত্যন্ত বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটল, মিথিলা ছুটে এসে মানুষটার হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে আনল আর ঠিক তখন রিভলবার থেকে একটা গুলি বের হয়ে আসে। ছোট ঘরটাতে প্রচণ্ড শব্দে সেটি প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। মিথিলা মানুষটার হাত ধরে ঝুলে থাকে, কিছুতেই ছাড়ে না। মানিক ঝটকা মেরে মিথিলাকে সরানোর চেষ্টা করে, পারে না। তখন সে বাম হাত দিয়ে মিথিলার ঘাড়টা ধরে তাকে টেনে সরায়। তারপর মিথিলার বুকের কাছে ফ্রকটা ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “এই ছেমড়ি? তোর কী মাথা খারাপ হয়েছে? এক ঘুষিতে আমি যদি তোর সবগুলো দাঁত না ফালাই তা হলে আমার নাম মাইনকার বাচ্চা মাইনকা না।”
আমি তখন আমার জীবনের সবচেয়ে বিচিত্র দৃশ্যটি দেখতে পেলাম। টুনি দুই হাত উপরে তুলে হিংস্র গলায় বলল, “এই যে মাইনকার বাচ্চা মাইনকা সাহেব, বাচ্চা মেয়েটারে ছাড়েন। আর যদি সাহস থাকে তা হলে আমার কাছে আসেন।”
মানিক নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, সে বিস্ফারিত চোখে টুনির দিকে তাকাল, বলল, “কী বললি?”