আমরা সিন্দুকটি ঘিরে দাঁড়িয়ে রইলাম। মিথিলার মতো আমাদেরও মনে হচ্ছে এখান থেকে আমরা চলে যাই। সিন্দুকের উপর ছোট একটা বাচ্চার কঙ্কাল–এই দৃশ্যটি এতো ভয়ানক যে সেটার দিকে তাকানো যায় না। সবচেয়ে ভয়ানক তার হাতের ছোট ছোট সোনার চুড়ি। সেদিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় এই ছোট মেয়েটা বুঝি এক্ষুনি তার সোনার চুড়িগুলো নাড়িয়ে উঠে বসে আমাদের দিকে তাকাবে, বলবে, তোমরা এতোদিন পরে এসেছ? যখন এখানে আমাকে খুন করে সিন্দুকের উপর শুইয়ে রেখেছিল তখন কেউ আসতে পারলে না? আমাকে বাঁচাতে পারলে না?
চঞ্চল আস্তে আস্তে বলল, “আমাদের কাছে সিন্দুকটার চাবি আছে। ইচ্ছে করলে আমরা সিন্দুকটা খুলে দেখতে পারি ভিতরে কী আছে।”
মিথিলা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “না। দেখতে চাই না।”
আমরাও মাথা নাড়লাম, বললাম, “থাকুক। আমরা বাইরে গিয়ে বড় মানুষদের বলি, তারা এসে এটা খুলুক।”
চঞ্চল হাসার চেষ্টা করে বলল, “তোরা যক্ষের ভয় পাচ্ছিস?”
”না, ঠিক তা না। কিন্তু–” আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না।
টুনি বলল, “আসলে ছোট একটা বাচ্চার কঙ্কাল দেখে খুব খারাপ লাগছে। সিন্দুকটা খুলতে হলে কঙ্কালটাকে সরাতে হবে। আমাদের কারো সেটা করতে ইচ্ছে করবে না।”
অনু মাথা নাড়ল, বলল, “টুনি ঠিকই বলেছে।”
চঞ্চল বলল, “ঠিক আছে। তা হলে ক্যামেরাটা দিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে আমরা যাই।”
চঞ্চল ক্যামেরা বের করে বেশ কয়েকটা ছবি তুলল, তারপর সেটা ব্যাগের ভিতরে রেখে বলল, “চল যাই।”
আমি বললাম, “চল।”
ঠিক তখন কাঁচ কাঁচ করে দরজাটা খুলে গেল, ভারী গলায় একজন বলল, “আগেই চলে যেও না। দাঁড়াও।”
আমরা চমকে উঠে সামনের দিকে তাকালাম, দরজায় মানিক আর তার পাহাড়ের মতো ওস্তাদ দাঁড়িয়ে আছে। মানিকের হাতে একটা ছোট রিভলবার, সেটা আমাদের দিকে তাক করে রেখেছে। ওস্তাদের হাতে একটা শাবল, আমরা যেটা উপরে রেখে এসেছিলাম। ভারী শাবলটা সে এমনভাবে ধরেছে যেন এটা একটা পাঠকাঠি!
০৮.
পাহাড়ের মতো মানুষটা ভেতরে ঢুকে আমাদের সবাইকে একনজর দেখে বলল, “দেখছিস মাইনকা, চার গোলামের সাথে এখানে দুই বিবি যোগ হইছে।”
প্রথমে আমার মনে হল আমাদের গোলাম বলে গালি দিচ্ছে, একটু পরে বুঝতে পারলাম সে তাসের গোলাম আর বিবির কথা বলছে। আমরা কিছু বললাম না, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। পাহাড়ের মতো মানুষটা ঘরের ভেতরে ঢুকে এদিক-সেদিক তাকাল। তারপর শাবলটা দিয়ে চঞ্চলের পেটে খোঁচা দিয়ে বলল, “কী, পেয়েছিস ব্যাঙের ছাতা? ব্যাঙের ছাতার জন্যে মাটির এতো নিচে আসতে হল?”
আমরা এবারেও কোনো কথা বললাম না। মানিক বলল, “আমি প্রথম যখন এই চার মক্কেলকে দেখেছি তখনি বুঝেছি কোনো গোলমাল আছে। মনে আছে ওস্তাদ, কী রকম চোখের পাতি না ফেলে মিথ্যা কথা বলে গেল? এরা যখন বড় হবে তখন কতো বড় ক্রিমিনাল হবে চিন্তা করতে পারেন?”
মোটা মানুষটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এই জন্যেই তো দেশের উন্নতি হয় না। ছোট পোলাপান ছোট পোলাপানের মতো থাকে না, বড় মানুষের কাজের মাঝে নাক গলায়।”
আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনারা কী চান?”
প্রথমে মানিক তারপর পাহাড়ের মতো মানুষটা হা হা করে হাসতে থাকে যেন আমি খুবই হাসির কথা বলেছি। এক সময় হাসি থামিয়ে মানিক বলল, “আমরা দুজন এখানে এসেছি আপনাদের অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্যে! আপনারা এই রকম কামেল মানুষ আমরা যদি আপনাদের অটোগ্রাফ না নেই তা হলে কে নিবে?”
মোটা মানুষটা বলল, “আচ্ছা দেখি, তোরাই বলতে পারিস কী না! বল দেখি আমরা কী জন্যে এসেছি?”
আমি অনুমান করতে পারছিলাম কিন্তু সেটা প্রকাশ করলাম না। বললাম, “জানি না।”
মানুষটা তার শাবলটা দিয়ে সিন্দুকটা দেখিয়ে বলল, “ঐ যে সিন্দুকটা দেখছিস না? তার ভিতর কী আছে বল দেখি?”
আমরা সেটাও অনুমান করতে পারছিলাম কিন্তু মুখে বললাম, “জানি না।”
“ঐ সিন্দুকের ভিতর আছে সাত রাজার ধন! মিশকাত খানের সাথে কাজ করতো ডাকাতের দল। তার ছিল কয়েকটা দোনলা বন্দুক। সে ডাকাতদের সেই দোনলা বন্দুক দিত ডাকাতি করার জন্যে। তারা ডাকাতি করে সোনাদানা আনতো, মিশকাত খান তার বখরা নিত। সব সে এই সিন্দুকে রেখে গেছে।”
চঞ্চল জিজ্ঞেস করল, “আপনি কেমন করে জানেন?”
“মিশকাত খানের ডান হাত ছিল গজু ডাকাত! আমি হচ্ছি গজু ডাকাতের ছেলের ঘরের নাতি। আমি যখন ছোট তখন আমার বাপ-চাচা আমার কাছে গল্প করেছে, বলেছে মিশকাত মঞ্জিলের নিচে আছে যক্ষের ধন। এই হচ্ছে সেই যক্ষের ধন। আমি ছয় বছর ধরে খুঁজেছি পাই নাই! তোরা সবাই একসাথে তিন দিনে খুঁজে পেয়ে গেলি। তোদের একটা পুরস্কার দেওয়া দরকার! বল দেখি তোদেরকে কী পুরস্কার দিব?”
চঞ্চল বলল, “জানি না।”
“তোদের সাথে একজনের পরিচয় করিয়ে দিব, তোদের বন্ধু। তারপর তোরা মিলেমিশে থাকবি।”
মানুষটা কী বলছে আমরা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, চঞ্চল বলল, “বন্ধু? কোন বন্ধু?”
পাহাড়ের মতো মানুষটা তখন সিন্দুকের উপর শুয়ে থাকা বাচ্চাটার কঙ্কালটাকে দেখিয়ে বলল, “এই যে তোদর বন্ধু! আরেকজন বিবি! চার গোলাম দুই বিবি ছিলি, এখন হবি চার গোলাম তিন বিবি!” এই ঘরে সবাই মিলে থাকবি। গল্প-গুজব করবি। যখন রাত হবে তখন নাকি সুরে কেঁদে কেঁদে ঘুরে বেড়াবি।”