টুনি বলল, “আমাদের কাছে দুইটা মোবাইল টেলিফোন আছে।”
চঞ্চল মাথা নেড়ে বলল, “মাটির তলায় নেটওয়ার্ক থাকার কথা না। তবু চেষ্টা করে দেখ।”
আমার ব্যাকপেকে লুকিয়ে রাখা মোবাইল ফোন আর টুনির মোবাইল ফোনটা বের করে পরীক্ষা করা হল, দেখা গেল চঞ্চলের অনুমান সত্যি। আসলেই নেটওয়ার্ক নেই।
টিটন জিজ্ঞেস করল, “তা হলে কী করব?”
“এই সিঁড়িটার সাথে দড়িটা বেঁধে দড়ি ধরে ধরে এগিয়ে যাই, তা হলে যদি হারিয়েও যাই, দড়ি ধরে ধরে আবার ফিরে আসতে পারব।”
টুনি বলল, “গুড আইডিয়া।”
আমি বললাম, “এইখানে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখে যাই তা হলে আলোটা দেখেও আসতে পারব।”
চঞ্চল বলল, “ঠিক বলেছিস।”
কাজেই লোহার সিঁড়িটাতে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখে আমরা দড়ি ছাড়তে ছাড়তে এগিয়ে যাই। সরু একটা সুড়ঙ্গ একজন মানুষ কষ্ট করে যেতে পারে। মাথা নিচু করে যেতে হয়, মাঝে মাঝে উপরে মাথা লেগে যায়। সুড়ঙ্গের দেয়ালটা ইট এবং পাথরের, কষ্ট করে এটা তৈরি করা হয়েছে। মাঝে মাঝে চুন দিয়ে আঁকি-ঝুঁকি করা, রহস্যময় একটা পরিবেশ।
সুড়ঙ্গের মাঝে ঠাণ্ডা। বিচিত্র শ্যাওলার মতো একটা গন্ধ। আমরা নিঃশব্দে একজনের পিছনে আরেকজন হেঁটে যেতে থাকি। সুড়ঙ্গটা আসলেই গোলকধাঁধা, সোজা যেতে যেতে হঠাৎ দেখা যায় ডান ও বাম দিকে দুটো সুড়ঙ্গ। ডান দিকে কিছু দূর গেলে আবার সেটা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এক ভাগ দিয়ে কিছু দূর গেলে দেখা যায় সেটা আবার কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। তার কোনো একটা দিয়ে গেলে দেখা যায় আমরা হঠাৎ করে আগের জায়গায় ফিরে এসেছি। ভারী বিচিত্র একটা ব্যাপার। এটা কে তৈরি করেছিল, কেন তৈরি করেছিল কিংবা কীভাবে তৈরি করেছিল কে জানে!
সুড়ঙ্গ ধরে হেঁটে হেঁটে আমরা যখন ধরেই নিয়েছি এখানে এই সুড়ঙ্গ ছাড়া আর কিছু নেই তখন হঠাৎ করে আমরা একটা খাড়া দেয়ালের সামনে হাজির হলাম। সেখানে একটা কাঠের দরজা। সেই দরজায় বিশাল একটা তালা ঝুলছে।
আমরা সবাই দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম, তালাটা দেখে একটু অবাক হয়ে সেটার দিকে তাকালাম। তালাটা ধরে একটু টানাটানি করে আমরা হাল ছেড়ে দিই। এতো বড় তালা ভেঙে ভিতরে ঢোকার কোনো উপায় নেই। কাঠের দরজাটাও একেবারে পাথরের মতো শক্ত। কতোদিন থেকে এটা এখানে আছে কিন্তু কিছু হয়নি। মনে হয় আরো শক্ত হয়েছে।
চঞ্চল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “চাবি ছাড়া এই তালা খুলে ভিতরে ঢোকা যাবে না।”
মিথিলা তখন পিছন থেকে বলল, “এই যে চাবি।”
আমরা চমকে উঠে বললাম, “চাবি?”
“হ্যাঁ।” মিথিলা এগিয়ে এসে আমাদের দিকে দুইটা চাবি এগিয়ে দেয়, একটা একটু বড়, আরেকটা ছোট। আমি অবাক হয়ে বললাম, “চাবি কোথায় পেলি?”
“সুড়ঙ্গের মাঝখানে এক জায়গায় দেয়ালে ঝোলানো ছিল আমি খুলে হাতে নিয়ে নিয়েছিলাম।”
টুনি মিথিলার পিঠে থাবা দিয়ে বলল, “ভেরি গুড, কমরেড মিথিলা।”
আমরাও মাথা নাড়লাম, বললাম, “ফ্যান্টাস্টিক।” মিথিলা যে নাকি সুরে আম্মুকে নালিশ করা ছাড়াও অন্য কাজ করতে পারে এই প্রথম আমি তার একটা প্রমাণ পেলাম।
টিটন চাবি দুইটা নিয়ে তালার ভিতরে ঢোকায়। একটা বেশি ছোট অন্যটা ভিতরে ঠিকভাবে ঢুকে গেল। বহু বছর ব্যবহার না করার কারণে তালাটা প্রথমে খুলতে চাইল না। চঞ্চল তখন তার ব্যাকপেক খুলে সেখান থেকে একটা শিশি বের করে সেটা থেকে খানিকটা তেল তালাটার ভিতরে ঢেলে দেয় তারপর কয়েকবার তালাটা নাড়াচাড়া করে চাবিটা ভিতরে ঢুকিয়ে কয়েকবার চেষ্টা করতেই সেটা ঘটাং করে খুলে গেল। বিশাল তালাটা দরজার কড়া থেকে খুলে নিচে রেখে আমরা দরজাটা ধাক্কা দিলাম, তখন কাঁচ কাঁচ শব্দ করে দরজাটা খুলে যায়।
আমরা টর্চ লাইট দিয়ে ভিতরে উঁকি দিলাম। ভেতরে বেশ বড় একটা ঘর। এর ছাদটাও বেশ উঁচু। ঘরটার দেয়ালটা নকশি কাটা। আমরা সামনের দিকে তাকালাম এবং হঠাৎ করে মনে হল আমরা সবাই পাথরের মতো জমে গেছি।
ঘরের মাঝখানে একটা বড় সিন্দুক। সিন্দুকের উপরে একটা কঙ্কাল। কঙ্কালটা ছোট, দেখে বোঝা যায় কম বয়সী কোনো বাচ্চার। শরীরের কাপড়টা এতো দিনে ক্ষয়ে গেছে, তবু বোঝা যায় এক সময়ে বাচ্চাটাকে লাল কাপড় দিয়ে জড়িয়ে রাখা ছিল। কঙ্কালটার ছোট ছোট হাতে সোনার চুড়ি। পায়ে সোনার নূপুর। মাথায় সোনার একটা টিকলি। নাকের নাকফুল আর কানের দুলগুলো খুলে পড়ে আছে।
দৃশ্যটি এতো ভয়ানক যে আমরা চিৎকার করতে পর্যন্ত ভুলে গেলাম। শুধু মিথিলা আতঙ্কে একটা চাপা শব্দ করে টুনিকে জড়িয়ে ধরল। টুনি মিথিলাকে ধরে ফিসফিস করে বলল, “ভয় নাই। কোনো ভয় নাই মিথিলা।”
অনু আস্তে আস্তে বলল, “যক্ষ–”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী বললি?”
“এই সিন্দুকে নিশ্চয়ই অনেক ধন-রত্ন আছে। এই ধন-রত্ন পাহারা দেবার জন্যে এই বাচ্চাটাকে খুন করে রেখে গেছে। সে যক্ষ হয়ে ধন-রত্ন পাহারা দিচ্ছে।”
মিথিলা ভয়ে ভয়ে বলল, “সত্যি?”
“রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছে এরকম একটা গল্প আছে, সম্পত্তি-সমর্পণ। যক্ষ হয়ে ধন-রত্ন পাহারা দেয়।”
মিথিলা ভয়ে ভয়ে বলল, “এখন যদি কেউ এই ধন-রত্ন ধরে তা হলে কী হবে?”
“যক্ষ কাউকে ধরতে দিবে না। কেউ ধরলে যক্ষ তাকে মেরে ফেলবে।”
মিথিলা বলল, “চল, আমরা এখান থেকে চলে যাই।”