আমরা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকি তখন আবার কান্নার শব্দটা শুনতে পেলাম। আমাদের বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। আমার মনে হতে লাগল এই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে প্যাঁচানো একটা লোহার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা আমরা চারজন ছাড়া আশে পাশে আরো কেউ আছে। আমরা তার কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি, তার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
হঠাৎ করে কে যেন খিলখিল করে হেসে উঠল, আর আমরা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম। আমরা স্পষ্ট শুনতে পেলাম খিলখিল করে হাসতে হাসতে কিছু একটা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, হঠাৎ করে লোহার সিঁড়িটা ঝনঝন শব্দ করে কাঁপতে থাকে। আমি ভয়ে চিৎকার করে আমার টর্চ লাইটটা জ্বালালাম এবং সাথে সাথে ভয়ংকর আতঙ্কে আমার সমস্ত শরীর জমে গেল।
বীভৎস কুৎসিত একটা মুখ লোহার সিঁড়িটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বড় বড় চোখ, লাল ঠোঁটের ফাঁকে কালো জিব, লম্বা লম্বা দাঁত, মাথায় শনের মতো চুল। ভয়ংকর জীবটি খিলখিল করে হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে আমার দিকে এগোতে থাকে। আমি আতঙ্কে চিৎকার করে অনুর গায়ের ওপর দিয়েই নিচে নামার চেষ্টা করতে থাকি। টিটন আর চঞ্চলও সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাবার চেষ্টা করে, ভয়াবহ আতঙ্কে একটা ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়।
ঠিক তখন উপর থেকে খিলখিল করে হেসে একজন পরিষ্কার গলায় বলল, “কী হল? তোরা এতো ভয় পাচ্ছিস কেন?”
আমরা উপরে তাকালাম। টুনি উপরে দাঁড়িয়ে আছে, একটু আগে যে ভয়ংকর বীভৎস মুখটি দেখেছিলাম সেটা আসলে একটা মুখোশ, টুনি সেই মুখোশটা খুলে হাতে ধরে রেখেছে। শুধু টুনি নয় আমরা দেখলাম টুনির পিছনে মিথিলাও আছে। পাজী মেয়েটা মুখে হাত দিয়ে খিলখিল করে হাসছে।
টুনির ওপর প্রচণ্ড রাগে আমাদের ফেটে পড়ার কথা ছিল কিন্তু আমরা কেউই রেগে উঠলাম না। এই ভয়ংকর আতঙ্কটা আসলে সত্যি নয় সেই জন্যেই আমরা সবাই টুনিকে মনে মনে মাফ করে দিয়েছি। কিন্তু সেটা তো আর বাইরে প্রকাশ করতে পারি না, তাই খুব রেগে যাবার ভান করে আমি বললাম, “এটা কী রকম ঠাট্টা?”
টুনি বলল, “আই অ্যাম সরি। এই দেখ আমি কান ধরছি-” সত্যি সত্যি সে নিজের কান ধরল তারপর মিথিলার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুইও ধর।” তখন মিথিলাও কান ধরল, তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আর কখনো এরকম করব না! মোটেও বুঝতে পারিনি তোরা এত ভয় পাবি।”
টিটন বলল, “ভয় পাবার কী আছে? আমার কাছে তাবিজ আছে না? হঠাৎ দেখে শুধু একটু চমকে উঠেছিলাম।” পরিষ্কার মিথ্যা কথা, আমরা সবাই যা ভয় পেয়েছিলাম সেটা আর বলার মতো না। এখনো আমাদের সবার বুক ধুকধুক করছে।
টুনি বলল, “ভয় না পেলে ভালো। খুবই ভালো।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোরা এখানে এলি কেমন করে? কেমন করে বুঝতে পারলি আমরা এখানে?”
“আমরা হচ্ছি ব্ল্যাক ড্রাগন। আমরা সবকিছু পারি।”
“ফাজলেমি করবি না। সত্যি করে বল।”
টুনি খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল, “খুবই সোজা! তোর ব্যাগে দেখ একটা মোবাইল টেলিফোন আছে। সকালবেলা যখন ঘর থেকে বের হচ্ছিলি তখন মোবাইলটা আমার টেলিফোনে ডায়াল করে কানেকশন নিয়ে তারপর রেখে দেওয়া হয়েছে। সেই কাজে সাহায্য করেছে কমরেড মিথিলা। তারপর আমরা ঘরে বসে তোদর সব কথা শুনেছি। পানির মতো সোজা।”
টুনির বুদ্ধি দেখে আমি বেকুব হয়ে গেলাম। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলাম না। আমি বললাম, “তুই এসেছিস তো এসে গেছিস। সাথে ওই মিথিলাকে নিয়ে এসেছিস কেন? এখন এইখানে ভয় পাবে, কান্নাকাটি করবে।”
মিথিলা বলল, “কখনো ভয় পাব না। কান্নাকাটি করব না। তোমরা ভয় পেয়েছ?”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “হ্যাঁ ভয় পেয়েছি। এরকম জায়গায় পড়লে যে কেউ ভয় পাবে।”
চঞ্চল বলল, “ব্যস! অনেক হয়েছে। চল আমরা নিচে নামতে শুরু করি।”
টুনি বলল, “ঠিক আছে। তোমাদের দলে আমরা দুজনও আছি। কালা গুইসাপের সাথে ব্ল্যাক ড্রাগন!”
আমরা এখন আর সেটা নিয়ে নতুন করে ঝগড়া শুরু করলাম না। টুনি বলল, “তোরা চিন্তা করিস না। আমরা আমাদের ব্যাগে করে অনেক ভালো ভালো খাবার এনেছি।”
অনু জিজ্ঞেস করল, “কী খাবার?”
“কোল্ড ড্রিংকস, স্যান্ড উইচ, চিপস, চকলেট, আপেল।”
অনু হাতে কিল দিয়ে বলল, “ভেরি গুড।”
আমাদের ভয় দেখানোর জন্যে টুনির উপর যেটুকু রাগ ছিল খাবারের কথা শুনে সেই রাগটুকুও উবে গেল।
আমরা আবার নিচে নামতে শুরু করি। টুনি বলল, “তোদের কবুতর দিয়ে বিষাক্ত গ্যাস আছে কী নেই সেটা দেখার বুদ্ধিটা একেবারে ফাটাফাটি।”
আমি বললাম, “আমাদের সব বুদ্ধিই ফাটাফাটি। সাথে থাক তা হলেই দেখবি।”
“আমরা তো সাথে থাকতেই চাই, তোরাই না হিংসুটের মতো আমাদের দলে নিতে চাস না।”
কথাটা সত্যি, তাই আমি আর কিছু বললাম না।
টিটন প্রথমে নিচে নামল, তারপর টর্চ লাইট দিয়ে চারদিক দেখে বলল, “খুবই আজব জায়গা।”
আমরাও যখন নিচে নেমে এসেছি তখন বুঝতে পারলাম আজব জায়গা বলতে সে কী বোঝাচ্ছে। আমাদের ধারণা ছিল আমরা বুঝি নিচে নেমে একটা হলঘরের মতো জায়গা পাব। কিন্তু আসলে নিচে কোনো ঘর নেই, নিচে একটা সুড়ঙ্গের মতো। সিঁড়ির নিচ থেকে সুড়ঙ্গটা শুরু হয়ে সেটা এদিক-সেদিক চলে গেছে। দেখে মনে হয় একটা গোলকধাঁধা।
চঞ্চল বলল, “আগেই কেউ রওনা দিস না। সত্যি যদি এটা গোলকধাঁধা হয় তা হলে একবার হারিয়ে গেলে আর ফিরে আসতে পারব না।”