অনু ইতস্তত করে বলল, “গর্তটা আরেকটু বড় কর।”
আমাদের মনে পড়ল অনু আমাদের তুলনায় বেশ নাদুস-নুদুস-আমরা ঢুকে যেতে পারলেও সে আটকে যাবে। টিটন তখন দুই পাশ থেকে আরো দুটি ইট খুলে ফেলল।
চঞ্চল জিজ্ঞেস করল, “কে আগে ঢুকবি?” টিটন বলল, “আমি। আমার কাছে তাবিজ আছে, আমার কোনো ভয় নাই।”
আমি অনু আর চঞ্চল একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম, টিটন যদি তার তাবিজের রহস্যটা জানত তা হলে সে কী করত কে জানে!
চঞ্চল বলল, “ঠিক আছে, তুই আগে ঢোক। তোর ব্যাগটা বাইরে থাকুক। টর্চ লাইটটা নিয়ে যা, ভেতরে গিয়ে টর্চ লাইট জ্বালিয়ে চারদিক দেখে আমাদের জানা। যদি অস্বাভাবিক কিছু দেখিস তা হলে বের হয়ে আসবি।”
টিটন বলল, ঠিক আছে। তারপর তার হাতে বাঁধা তাবিজটা একবার চুমু দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী অবস্থা? ভিতরে কিছু আছে?”
টিটন বলল, “মাকড়শার জাল। আর বোঁটকা গন্ধ।”
“আর কিছু?”
“মাটিতে গাছ পাতা, মনে হয় এটা বেজির বাসা।”
“আর কিছু?”
“দুইটা বাদুর উড়ছে।”
চঞ্চল বলল, সাবধান, “বাদুর যেন না কামড়ায়। বাদুরের মাঝে র্যাবিজ ভাইরাস থাকে।”
“আমাকে কামড়াবে না। আমার তাবিজ আছে।”
“বাদুর তো জানে না, তোর তাবিজ আছে।”
আমি জিজ্ঞেস করলামম, ”ভিতরে আর কী আছে?”
“সামনে একটা ঘোরানো সিঁড়ি। নিচে নেমে গেছে।”
চঞ্চল বলল, “গুড। আগে তোর ব্যাগটা ভিতরে ঢুকিয়ে দিই। নে ধর।”
আমরা ঠেলে টিটনের ব্যাগটা ঢুকিয়ে দিলাম।
আমি বললাম, “এবারে আমি ঢুকি?”
“ঠিক আছে।”
আমি প্রথমে আমার ব্যাগটা ঠেলে ভিতরে ঢুকিয়ে নিজে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেলাম। টিটন ঠিকই বলেছে ভেতরে একটা বোটকা গন্ধ। কীসের গন্ধ কে জানে। আমি টর্চ লাইট জ্বালিয়ে একটু এগিয়ে সিঁড়িটার দিকে তাকালাম। একটা লোহার সিঁড়ি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে নিচে নেমে গেছে। নিচে অন্ধকার, কী আছে দেখা যায় না।
আমি আর টিটন যখন টর্চ লাইট জ্বালিয়ে নিচে নেমে যাওয়া সিঁড়িটার দিকে তাকালাম-একটা লোহার সিঁড়ি পেঁচিয়ে নিচে নেমে গেছে। নিচে অন্ধকার, কী আছে দেখা যায় না।
আমি আর টিটন যখন টর্চ লাইট জ্বালিয়ে নিচে নেমে যাওয়া সিঁড়িটা দেখছি তখন ছোট গর্তটা দিয়ে প্রথমে কবুতর আর দুটি ব্যাগ ঢুকিয়ে দিল তারপর অনু আর চঞ্চলও ঢুকে গেল। আমরা চারজন এখন গাদাগাদি করে ছোট একটা ঘরে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের সবার হাতেই একটা করে টর্চ লাইট, ছোট ঘরটাকে সেটা বেশ ভালোভাবে আলোকিত করে রেখেছে। বাদুরগুলো আলোর কারণে খুবই ঝামেলায় পড়েছে মনে হয়, খানিকক্ষণ উড়ে শেষে গর্ত দিয়ে বের হয়ে গেল।
চঞ্চল এবার তার কাজ শুরু করে দেয়। প্রথমে চিকন নাইলনের একটা দড়ি দিয়ে কবুতরের খাঁচাটাকে বাঁধল। তারপর সেই খাঁচাটা আস্তে আস্তে নিচে নামিয়ে দিতে থাকে। মাঝামাঝি যাবার পর হঠাৎ সেটা ডানা ঝাঁপটে ওঠে, আমরা সবাই চমকে উঠলাম। টিটন জিজ্ঞেস করল, “মরে গেছে না কি?”
আমি বললাম, “না।”
চঞ্চল আবার কবুতরটা নিচে নামাতে থাকে। সেটা আবার এক-দুইবার ডানা ঝাঁপটে উঠল, একবার মনে হয় ভয় পেয়ে একটু ডেকেও উঠল। কবুতরটা যখন একেবারে নিচে নামানো হল আমরা দেখলাম সেটা খাঁচার ভেতরে হাঁটাহাঁটি করছে। তার মানে এখানে বিষাক্ত কোনো গ্যাস নেই।
চঞ্চল বলল, “এবারে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে খুব আস্তে আস্তে নামাতে থাকি। যদি মিথেন গ্যাস থাকে তা হলে আগুন ধরে যাবে। তা হলে আমরা নিচে নামব না।”
আমরা মাথা নাড়লাম, বললাম, “ঠিক আছে।”
আমরা একটা বড় মোমবাতি জ্বালিয়ে তার মাঝখানে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিচে নামাতে শুরু করলাম। আমরা ভয়ে ভয়ে ছিলাম, হঠাৎ যদি ভক করে আগুন ধরে একটা বিস্ফোরণ হয় তা হলে আমরা কী করব? ঐ ছোট গর্ত দিয়ে হাচড়-পাঁচড় করে বের হতে পারব?
কিন্তু কোনো বিস্ফোরণ হল না, মোমবাতিটা বেশ ভালোভাবেই জ্বলতে লাগল। চঞ্চল তখন সন্তুষ্টির ভান করে বলল, “ঠিক আছে। কোনো সমস্যা নাই।”
আমি বললাম, “চল নামি।”
“চল।”
“কে আগে?”
টিটন বলল, “আমি।” তাবিজের কারণে এখন তার অনেক সাহস, অনেক মজা।
আমরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে শুরু করলাম। প্রথমে টিটন তারপর চঞ্চল তারপর অনু সবার শেষে আমি। লোহায় মরচে ধরা সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় সেটা অল্প অল্প দুলতে থাকে, হঠাৎ করে সেটা ভেঙে পড়বে কী না সেটা নিয়ে আমার একটু দুশ্চিন্তা লাগতে থাকে। সাবধানে আস্তে আস্তে পা ফেলে আমরা যখন মাঝামাঝি এসেছি তখন আমার হঠাৎ মনে হল আমি যেন একটা শব্দ শুনতে পেলাম। মনের ভুল মনে করে আরো দুই পা নামার পর আমি আবার সেই শব্দটা শুনলাম, হাততালি দেবার মতো শব্দ। আমি চাপা গলায় বললাম, “চুপ! সবাই চুপ!”
আমার গলার স্বরে নিশ্চয়ই কিছু একটা ছিল–একসাথে সবাই চুপ করে গেল। চঞ্চল জিজ্ঞেস করল, “কী?”
আমি কাঁপা গলায় বললাম, “একটা শব্দ।” আমার কথা শেষ হবার সাথে সাথে সেই হাততালি দেওয়ার মতো শব্দটা আবার শোনা গেল। আমরা সবাই তখন একসাথে চমকে উঠি।
চঞ্চল বলল, “সবাই টর্চ লাইট নিভিয়ে ফেল।”
কেন টর্চ লাইট নিভাতে হবে আমরা ঠিক বুঝতে পারলাম না, কিন্তু সবাই নিভিয়ে ফেললাম। সাথে সাথে ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে পুরোটুকু ঢেকে গেল।
আবার হাততালির শব্দ শুনতে পেলাম তার সাথে মেয়ে কণ্ঠে একটু কান্নার শব্দ। টিটন কাঁপা গলায় বলল, “ইয়া মাবুদ।”