চঞ্চল মাথা নাড়ল, বলল, “মনে হয় তাই হবে।”
টিটন বলল, “যারা মামলা করতে চায় করুক, আমরা আমাদের কাজ করি।”
“হ্যাঁ। আমরা আমাদের কাজ করি।”
“এই শাবলটা কোথায় লুকিয়ে রেখে যাবি?”
“দোতলার সেই ঘরটাতে রেখে এলেই হয়।”
টিটন বলল, “দে। রেখে আসি। তোরা অপেক্ষা কর।”
“তোর ভয় করবে না তো?”
টিটন দাঁত বের করে হাসল, “ধুর! ভয় করবে কেন?” তার বিশাল তাবিজটা দেখিয়ে বলল, “এই তাবিজ আছে না আমার?”
ভারী শাবলটা ঘাড়ে নিয়ে টিটন মিশকাত মঞ্জিলের ভিতরে ঢুকে যায়। চঞ্চল আমাকে আর অনুকে ডেকে বলল, “একটা জিনিস তোদের বলি। কাউকে বলবি না তো?”
“বলব না।”
“খোদার কসম?”
“খোদার কসম।”
“মনে আছে, টিটন আমাকে তার তাবিজটা দিয়ে গিয়েছিল, ধরে রাখলে গরম হয় সেটা পরীক্ষা করার জন্যে?”
আমি মাথা নাড়লাম, “মনে আছে।”
চঞ্চল বলল, “তাবিজটা মোম দিয়ে বন্ধ করা। গরম করে মোম গলিয়ে আমি ভিতরের সবকিছু বের করেছিলাম।”
“তাই না কি? কী আছে ভিতরে?”
“ছোট একটা কাগজে হাবিজাবি লেখা। আমি কী করেছি জানিস?”
“কী করেছিস?”
“হাবিজাবি কাগজটা ফেলে নতুন একটা কাগজ ঢুকিয়ে মোম দিয়ে ভরাট করে দিয়েছি।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। কাগজটাতে কী লেখা জানিস?”
“কী?”
“আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্র, ই ইকুয়েলস টু এম সি স্কয়ার।”
আমি আর অনু হি হি করে হাসলাম। অনু বলল, “তোর বৈজ্ঞানিক তাবিজ আগের থেকে ভালো কাজ করছে!”
“হ্যাঁ। টিটনটা যে কী বোকা।”
আমরা দেখলাম আমাদের টিটন শাবলটা রেখে মিশকাত মঞ্জিল থেকে বের হয়ে আসছে তাই তাবিজ নিয়ে আলোচনাটা থামিয়ে দিলাম। টিটন এসে বলল, “কী অসাধারণ তাবিজ! এখন আর একটুও ভয় করে না।”
আমরাও মাথা নাড়লাম, বললাম, “অসাধারণ!”
৭-৮. পেয়ারা গাছের নিচে
সকালবেলা আমরা পেয়ারা গাছের নিচে আমি টিটন আর চঞ্চল একত্র হয়েছি। অনু এখনো আসেনি সে সবসময়ই দেরি করে আসে। মোটাসোটা মানুষেরা মনে হয় সবকিছুই আস্তে ধীরে করে। অনু পৌঁছলেই রওনা দিয়ে দেব, তার জন্যে অপেক্ষা করছি। এতো সকালে কোথায় যাই সেটা নিয়ে আমাদের বাসায় কেউ তেমন কিছু বলেনি। আগেও এরকম অনেকবার হয়েছে–বাসার সবাই মেনে নিয়েছে যে আমরা মাঝে মাঝে এরকম ছোটখাট পাগলামি করি। আমাদের বাসায় শুধু মিথিলা খুব ভোরে উঠে জিজ্ঞেস করল, “ভাইয়া, কই যাও?”
আমি আমার অভ্যাস মতো খেঁকিয়ে উঠলাম, “সেটা তোর জানার দরকার কী?”
ভেবেছিলাম আমার ধমক খেয়ে মিথিলা নাকি সুরে আম্মুকে নালিশ করে দেবে, আম্মু দেখো, ভাইয়া আঁমাকে বাঁকা দিচ্ছে কিন্তু কী কারণ কে জানে, সে নালিশ করল না। শুধু যে নালিশ করল না তা না–মনে হল একটু মিচকি হাসি দিল! কেন নালিশ না করে মিচকি হাসি দিল আমি এখন আর সেটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না।
অনু কেন এতো দেরি করে আসছে আমরা যখন সেটা নিয়ে তাকে বকাবকি করছি তখন দেখলাম সে হেলতে দুলতে আসছে। পিঠে বিশাল ব্যাকপেক। হাতে একটা খাঁচা সেখানে সাদা রঙের একটা কবুতর। আমরা গরম হয়ে বললাম, “এতো দেরি করে এসেছিস কেন?”
অনু আরো গরম হয়ে বলল, “সকালবেলা খাঁচার ভিতর একটা কবুতর হাতে নিয়ে রওনা হয়ে দেখ সকাল সকাল আসতে পারিস কি না। হেন-ত্যাননা একশটা প্রশ্ন।”
“তুই কী বলেছিস?”
“বলেছি আমরা কবুতরের পায়ে লাগিয়ে চিঠি পাঠানো যায় কি না সেটা পরীক্ষা করার জন্যে নিয়ে যাচ্ছি।”
চঞ্চল বলল, “ভেরি গুড। খুবই ভালো উত্তর দিয়েছিস।”
টিটন বলল, “অনুর মতো বানিয়ে বানিয়ে আর কেউ বলতে পারে না। মনে নাই, সেই দিন ব্যাঙের ছাতার গল্পটা বলেছিল?”
আমি বললাম, “বড় হয়ে লেখক হবে তো, সেই জন্যে এখন থেকেই গুলপট্টি মারা প্র্যাকটিস করছে।”
চঞ্চল বলল, “আয় রওনা দেই।”
“চল।” আমরা রওনা দিলাম।
আমরা ভয়ে ভয়ে ছিলাম যে, মিশকাত মঞ্জিলে গিয়ে যদি দেখি ফুটকি জিব মানিক আর তার ওস্তাদ মিঃ পাহাড় ঘোরাঘুরি করছে, তা হলে একটা মহা ঝামেলা হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের কপাল ভালো এতো সকালে সেখানে কেউ নাই, শুধু পাখিগুলো কিচিরমিচির করছে। আমরা তাড়াতাড়ি গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় আমাদের ঘরটাতে ঢুকে গেলাম। আমরা ব্যাকপেকগুলো পিঠ থেকে খুলে নিচে রেখে দিই, টিটন আগাছার মাঝে লুকিয়ে রাখা শাবলটা বের করে আনল।
আমি বললাম, “মনে আছে ঐ দিন একটা বেজি বের হয়েছিল? ভিতরে বেজি থাকে মনে হয়।”
চঞ্চল বলল, “হ্যাঁ।”
“আজকেও যদি ভেতরে থাকে?”
“যদি একটু শব্দ করি তা হলেই পালিয়ে যাবে।”
আমরা শাবল দিয়ে দেয়ালে এখানে সেখানে ঘা দিলাম তখন সত্যি সত্যি প্রথমে একটা বড় বেজি তারপর দুইটা ছোট বেজি গর্ত দিয়ে বের হয়ে পালিয়ে গেল। অনু বলল, “বেজি পরিবার সুখী পরিবার।”
চঞ্চল বলল, “আহা বেচারা, আমরা তাদের বাড়িটা নষ্ট করে ফেলব। এখন আর সুখী পরিবার থাকবে না।”
আমি বললাম, “এখানে অনেক জায়গা আছে, বেজি পরিবার থাকার জন্যে অনেক জায়গা পেয়ে যাবে।”
টিটন জিজ্ঞেস করল, “আমরা কোথায় গর্তটা করব?”
চঞ্চল বলল, “যেখানে ছোট গর্তটা আছে সেখান দিয়েই শুরু করি।”
টিটন তখন শাবলটা দিয়ে সেখানে জোরে একটা ঘা দিল, সাথে সাথে একটা ইট খুলে এলো। তারপর আরেকটা, তারপর আরেকটা। দেখতে দেখতে একজন মানুষের ঢোকার মতো একটা গর্ত হয়ে গেল। চঞ্চল হাত তুলে বলল, “এখন থাম।”