মানুষটা তার গমগমে গলায় বলল, “এই মাইনকা, ওঠ, আয় যাই।”
“চল ওস্তাদ।” বলে মাইনকা, যার আসল নাম মনে হয় মানিক মোটর সাইকেলের পিছনে উঠল। পাহাড়ের মতো মানুষটা মোটর সাইকেল স্টার্ট করে চঞ্চলের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই ছেলে, শোন।”
চঞ্চল বলল, “কী হল?”
“কথা কম বলবা। বুঝেছ? কথা বেশি বললে মানুষ বিরক্ত হয়। আর মানুষ বিরক্ত হলে একদিন তোমারে ধরে পাটকান দিয়ে ফেলে দিবে। বুঝেছ?”
চঞ্চল বলল, “পাটকান মানে কী?”
“জিজ্ঞেস কর না। তা হলে যদি দেখায়া দেই তা হলে তোমার খবর হয়ে যাবে। যাও, বাড়ি যাও!” বলে মানুষটা একটা ধমকের ভঙ্গি করল।
লোক দুইজন মোটর সাইকেল চালিয়ে চলে যাবার পর চঞ্চল বলল, “দুইটা মানুষকে ইনডাকশন কয়েল দিয়ে ইলেকট্রিক শক দেওয়া দরকার। কত বড় বেয়াদপ।”
বেয়াদপ মানুষ দুইটা নিয়ে কথা বলতে বলতে আমরা ফিরে আসতে লাগলাম। বাসার কাছাকাছি এসে দেখি পেয়ারা গাছে টুনি আর মিথিলা পা ঝুলিয়ে বসে আছে। এর আগে মিথিলাকে কোনোদিন গাছে উঠতে দেখিনি, আজই প্রথম। টুনির সাথে থেকে থেকে তার অনেক উন্নতি হয়েছে মনে হয়। আমি বললাম, “মিথিলা, গাছে উঠেছিস?”
“হ্যাঁ।”
“পড়ে ঠ্যাং ভাঙলে বুঝবি মজা।”
“ভাঙলে ভাঙবে।”
টুনি বলল, “আসলে এখানে ব্ল্যাক ড্রাগনের জরুরি মিটিং হচ্ছে।”
আমরা বললাম”অ।”
শুধু যে আমাদের নাম ব্ল্যাক ড্রাগন দখল করে আছে তা না, আমাদের পেয়ারা গাছটাও দখল করে নিয়েছে। আমরা তাই হেঁটে হেঁটে চঞ্চলের বাসার দিকে যেতে থাকি। পিছন থেকে মিথিলা বলল, “কালা গুইসাপ! কালা গুইসাপ!!”
কথাটা শুনে চঞ্চলের কোনো ভাবান্তর হল না, অনু হেসে ফেলল, তার করা অনুবাদটা ব্যবহার হচ্ছে সেই আনন্দেই মনে হয়, টিটন একটা গর্জন করল আর আমার মনে হল মিথিলাকে আমি নিশ্চয়ই একদিন খুন করে ফেলব। পত্রিকায় খবর বের হবে, ‘মর্মান্তিক : বড় ভাইয়ের হাতে ছোট বোনের মৃত্যু।‘ শুধু আসল খবরটা কেউ জানতে পারবে না।
.
আমাদের বাকি দিনটা কেটে গেল পরের দিনের অভিযানের প্রস্তুতি নিতে নিতে। লিস্টটা বিশাল, সব মিলিয়ে তেপ্পান্নটা আইটেম। সবচেয়ে বড় আইটেম হচ্ছে শাবল আর সবচেয়ে ছোট হচ্ছে টুথপিক। চঞ্চল লিস্টের পাশে তারকা চিহ্ন দিয়েছে, কোনো কোনোটা তিন তারকা যার অর্থ খুবই গুরুত্বপূর্ণ–যেমন শাবল, হাতুড়ি, চাকু, দড়ি, টর্চ লাইট, ম্যাচ, মোমবাতি, কবুতর এইগুলো। কোনো কোনোটা তারকা চিহ্নবিহীন যার অর্থ কম গুরুত্বপূর্ণ। যেমন : কমিক বই, এফ এম রেডিও, এনার্জি সেভিং বাল্ব, আঠা আর রাবার ব্যান্ড। এগুলো কেন তালিকায় আছে আমরা সেটাই বুঝতে পারলাম না! চঞ্চলকে কিছু বলিনি কিন্তু শুরুতেই আমরা এগুলো বাদ দিয়ে দিয়েছি।
চঞ্চলের ল্যাবরেটরিতে বসে আমরা লিস্টটা দেখে একটা জিনিস আবিষ্কার করলাম, কাল ভোরে যখন আমরা এগুলো নিয়ে রওনা দিব তখন সবাই চোখ কপালে তুলে বলবে, তোরা এই বাক্স-প্যাটরা নিয়ে কোথায় রওনা দিয়েছিস? সবচেয়ে ঝামেলা হবে শাবলটা নিয়ে, ভারী একটা শাবল ঘাড়ে নিয়ে টেনে টেনে যাচ্ছি দৃশ্যটাই কাউকে বোঝানো যাবে না।
আমি বললাম, “কাল সকালের জন্যে না রেখে শাবলটা আজকেই মিশকাত মঞ্জিলে রেখে আসি।”
অনু মাথা নাড়ল, বলল, “গুড আইডিয়া।”
“যদি কেউ জিজ্ঞেস করে শাবল নিয়ে কই যাচ্ছি, আমরা কী বলব?”
টিটন বলল, “আমরা কোনো উত্তর না দিয়ে মুখ ভেংচে দেব। আমাদের কী ঠ্যাকা পড়েছে যে সবার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে?”
আমাদের বাসা থেকে মরচেধরা শাবলটা নিয়ে যখন বের হয়েছি তখন মিথিলা জানতে চাইল, “ভাইয়া, শাবল নিয়ে কই যাও।”
আমি উত্তর না দিয়ে মুখ ভেংচে দিলাম, তখন মিথিলা নাকি সুরে আম্মুকে নালিশ করতে লাগল, “আম্মু ভাইয়া আমাকে মুখ ভাংচায়।”
আম্মু চলে আসার আগে আমি বের হয়ে গেলাম। ভারী শাবলটা নিয়ে যখন আমরা রাস্তা ধরে যাচ্ছি তখন অনেকেই সন্দেহের চোখে তাকাল কিন্তু কেউ কিছু প্রশ্ন করল না। মিশকাত মঞ্জিলের কাছে গিয়ে এদিক-সেদিক তাকিয়ে যখন ভিতরে ঢুকে গেছি তখন চমকে উঠে আবিষ্কার করলাম সেখানে ফুটকি জিব মানিক আর তার পাহাড়ের মতো ওস্তাদ দাঁড়িয়ে আছে। শুধু যে আমরা চমকে উঠলাম তা নয়, তারাও আমাদের দেখে চমকে উঠল। ফুটকি জিব মানিক জিজ্ঞেস করল, “তোমরা এখানে কী কর?”
এক সেকেন্ড দেরি না করে চঞ্চল বলল, “ব্যাঙের ছাতা তুলে নিতে এসেছি।”
ছোট একটা ব্যাঙের ছাতা তুলতে এতো বড় একটা শাবল লাগে কী না তারা ইচ্ছা করলেই সেই প্রশ্নটা করতে পারত, কিন্তু করল না। এবারে আমি একটা সাহসের কাজ করে ফেললাম, জিজ্ঞেস করলাম, “আপনারা এখানে কী করছেন?”
আমি ভেবেছিলাম লোকগুলো ধমক দিয়ে বলবে, “তোমার সেটা জানার দরকার কী?” কিন্তু তা না করে তারা কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল, ফুটকি জিব বলল, “না, মানে ইয়ে আমরা তো রিয়েল স্টেটে কাজ করি, সেই জন্যে মানেইয়ে”
পাহাড়ের মতো মানুষটা তখন ধমক দিয়ে বলল, “আবে মাইনকা। প্যাচাল পারিস না। আয় যাই।”
মানিক বলল, “চলেন।” তারপর দুইজন বের হয়ে গেল। অনু বলল, “খুবই সন্দেহের ব্যাপার।”
আমি বললাম, “মনে নাই, আব্বু বলেছিলেন মিশকাত মঞ্জিল নিয়ে মামলা হয়েছে। এরা মনে হয় হারু পার্টি। মামলায় হেরে গিয়ে এখন কেমন করে দখল করবে সেটা চিন্তা করছে।”