আমি বললাম, “টিটনকে বিষ পিঁপড়া কামড় দিয়েছে আর সেই জন্যে টিটন পিঁপড়ার সাথে মারামারি করছে।”
চঞ্চল বলল, “বিষ পিঁপড়ার বিষ আসলে এক ধরনের এসিড। একটু চুন যদি লাগাতে পারিস এসিড বেস কাটাকাটি হয়ে যাবে।”
সে কী বলল আমি কিংবা টিটন কিছুই বুঝতে পারলাম না–কোনো সময়েই পারি না। টিটন ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বলল, “আমার তো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নাই, যে আমি পকেটে চুন নিয়ে ঘুরি!”
আমি চঞ্চলকে বললাম, “আয় উপরে আয়।”
কোনো বড় মানুষ হলে জিজ্ঞেস করত, কেন? গাছের উপরে কেন উঠে বসতে হবে? চঞ্চল বড় মানুষ না তাই সেও কোনো কথা না বলে গাছের উপরে উঠে বসল। আমি বললাম, “কী মজা, স্কুলে যেতে হবে না!”
টিটন বলল, “হ্যাঁ, কী মজা!” তার সবগুলো দাঁত আনন্দে বের হয়ে এলো। টিটন আমাদের থেকে এক ক্লাস নিচে পড়ে। আমরা সব আশেপাশে থাকি তাই কে কোন ক্লাসে পড়ে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাই না। তা ছাড়া টিটন যে এখনো লেখাপড়ার মাঝে আছে সেটাই একটা বিরাট ব্যাপার-তার অনেকদিন আগেই কোনো একটা ডাকাতের দলে যোগ দেওয়ার কথা ছিল, না হলে জলদস্য হওয়ার কথা ছিল। ছোট বলে কেউ তাকে নিবে না সে জন্যে যেতে পারছে না।
চঞ্চল বলল, “স্কুলটা সারা বছরই বন্ধ থাকা উচিত। আমাদের কী কী পড়তে হবে সেগুলো শুধু ই-মেইল করে জানিয়ে দেবে। আমরা পড়ে নেব।”
আমি বললাম, “যাদের ই-মেইল নেই?”
চঞ্চল মুখ শক্ত করে বলল, “যাদের ই-মেইল নেই তাদের লেখাপড়া করার দরকার নেই।”
আমাদের কারোই ই-মেইল নেই তাই আমরা গরম হয়ে উঠলাম। আমি বললাম, “তোকে বলেছে? সবার কি ই-মেইল আছে? নাই!”
“ঠিক আছে ঠিক আছে। যাদের ই-মেইল নাই তাদেরকে সেল ফোনে এসএমএস করে দেবে।”
আমরা সবাই বলি মোবাইল ফোন, চঞ্চল ঢং করে সেটাকে বলে সেল ফোন। টিটন বলল, “যাদের মোবাইল ফোন নাই?”
চঞ্চল বলল, “এখন সবারই বাসায় একটা না একটা সেল ফোন আছে।”
“যদি না থাকে?”
“আছে।”
টিটন গরম হয়ে বলল, “যদি থাকে কিন্তু ব্যবহার করতে না দেয়?”
আমাদের তখন মনে পড়ল টিটন কয়দিন আগে তার বড় বোনের মোবাইল ফোন দিয়ে তাদের ক্লাসের একটা ছেলের কাছে খুব খারাপ একটা এসএমএস পাঠিয়েছিল। ফোন নম্বরটা ঠিক করে লিখে নাই তাই সেটা ভুল করে চলে গিয়েছিল অন্য একজনের কাছে। সেই অন্য একজন আবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ–ডিসি না মন্ত্রী না যেন এমপি। সেই মানুষটা খবর দিল পুলিশকে, পুলিশ খবর দিল র্যাবকে, র্যাব খবর দিল মিলিটারিকে–সব মিলিয়ে হুলুস্থুল অবস্থা! আরেকটু হলে টিটনের আপুকে ধরে নিয়ে ক্রস ফায়ার করে মেরেই ফেলছিল! অনেক কষ্ট করে সেই ঝামেলাটা মিটেছে আর তারপর থেকে টিটন তার বাসায় কোনো মোবাইল ফোন ধরতে পারে না।
চঞ্চল বলল, ঠিক আছে, যাদের সেল ফোন নেই তাদের কাছে চিঠি পাঠাবে।”
চঞ্চলের আইডিয়াটা আমাদের খুব পছন্দ হল। ঘুম থেকে উঠে দেখব একটা চিঠি, সেই চিঠিতে লেখা আছে আজকে অমুক বাংলা কবিতাটা পড়, ইংরেজি বইয়ের অমুক চ্যাপ্টারটা ট্রানস্লেশন কর, অঙ্ক বইয়ের অমুক অঙ্কগুলো কর। ব্যস, আমরা তখন ঘরে বসে কিংবা এই পেয়ারা গাছে বসে সেটা করে ফেললাম। কোনো ঝামেলা নেই। টিটন বলল, “গভমেন্টের অনেক টাকা বেঁচে যাবে। মাস্টারদের বেতন দিতে হবে না। বেত কিনতে হবে না।”
আমি বললাম, “বেত মনে হয় গভমেন্টের টাকা দিয়ে কিনে না। স্যার ম্যাডামেরা নিজেদের পকেটের টাকা দিয়ে কিনে।” “অসম্ভব।” টিটন মুখ শক্ত করে বলল, “স্যার-ম্যাডামেরা নিজেদের পকেটের টাকা দিয়ে কোনোদিন কিছু কিনবে না। প্রত্যেক বছর যখন পাঠ্যবই ছাপায় তখন বেতগুলো রেডি করে। তারপর বইয়ের বান্ডিল আর বেতের বান্ডিল স্কুলে স্কুলে পাঠিয়ে দেয়।”
চঞ্চল ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “তুই কেমন করে জানিস?”
টিটন বলল, “না জানার কী আছে? সবাই জানে।”
এই রকম যুক্তির উপর তো আর তর্ক করা যায় না, তাই আমরা আর তর্ক করলাম না। তা ছাড়া টিটনের সাথে আমরা সাধারণত তর্ক করি না। তর্কে সুবিধে করতে না পারলে সে কথা নেই বার্তা নেই একটা ঘুষি মেরে দেয়।
আমরা তিনজন পেয়ারা গাছে পা দুলিয়ে বসে থাকলাম আর আমাদের মনে হতে লাগল সত্যি সত্যি বুঝি স্কুল ছুটির আনন্দটা শুরু হয়েছে। স্কুলে যাওয়ার তাড়া নেই, কোন ক্লাসে কোন স্যার কোন ম্যাডাম এসে কী পড়া জিজ্ঞেস করবেন সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই। কোন হোমওয়ার্ক ভুল করে (কিংবা ইচ্ছা করে) করা হয় নাই সেটা নিয়েও অশান্তি নেই। ক্লাসে বসে কখন স্কুল ছুটি হবে সেটা নিয়েও সারাক্ষণ উশখুশ করা নেই। আমরা এখন যতক্ষণ খুশি পেয়ারা গাছের উপর বসে থাকতে পারব, তারপর যখন ইচ্ছে তখন গাছ থেকে নেমে রাস্তা ধরে হাঁটতে পারব। পুকুর ঘাটে গিয়ে শার্ট খুলে ঝপাং করে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারব, পুকুর থেকে উঠে ভিজে কাপড়ে ঘুরাঘুরি করে শরীরের মাঝেই কাপড় শুকিয়ে বাসায় ফিরে আসতে পারব। কিছু একটা খেয়ে আবার বের হতে পারব, ইচ্ছে হলে সারাদিন একটা টেনিস বল দিয়ে বোম্বাস্টিক খেলতে পারব। শুধু সন্ধ্যে হলে বাসায় ফিরে আসতে হবে–যদি কোনোভাবে সন্ধ্যের সময় বাসায় ফিরে আসার নিয়মটা না থাকত তা হলে আমাদের আর কিছু চাওয়ার ছিল না!
চঞ্চল বলল, “এই ছুটিটা ভালো করে কাটাতে হবে।”