টিটন বলল, “তোদের বাসায় তো কবুতর আছে। তুই একটা ধরিস না কেন?”
অনু বলল, “কবুতর রাত্রে ধরে রাখতে হয়। দিনের বেলায় সব উড়ে চলে যায়। এখন আর ধরা যাবে না।”
টিটন বলল, “ঠিক আছে। আজ রাত্রে ধরে রাখবি।”
অনু মাথা নাড়ল, “রাখব। ধরে রাখব।”
আমি বললাম, “তা হলে কাল ভোরে মিশকাত মঞ্জিল অভিযান।”
সবাই মাথা নাড়ল।
”আজকে সবাই লিস্ট ধরে সবকিছু জোগাড় করবি।”
সবাই আবার মাথা নাড়ল।
”কাউকে কেউ কিছু বলতে পারবি না।”
সবাই আবার আরো জোরে মাথা নাড়ল।
চঞ্চল বলল, “আয় আমরা এখন মিশকাত মঞ্জিলটা একটু দেখে আসি।”
টিটনের চোখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, “কী দেখবি?”
“বাইরে থেকে ঘুরে দেখে আসি বিল্ডিংটা কতো বড়, কোনদিকে কতটুকু। আমরা যখন ভিতরে ঢুকব তখন যেন আন্দাজ থাকে কোথায়, কোনদিকে আছি।”
আমরা তখন গাছ থেকে নেমে মিশকাত মঞ্জিলের দিকে হেঁটে যেতে থাকি। কাছাকাছি পৌঁছে এদিক-সেদিক তাকালাম, যখন দেখলাম আশেপাশে কেউ নেই, কেউ আমাদের দেখছে না, তখন আমরা শুট করে গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলাম। সকালবেলা বলেই হয়তো অনেক পাখি কিচিরমিচির করছে। আমরা মিশকাত মঞ্জিলটা ভালো করে দেখলাম, চঞ্চল একটু মাপজোক করল, টিটন বুক ফুলিয়ে বলতে লাগল সে আর ভূতকে ভয় পায় না। আমরা চাইলে সে এখন একাই ভিতরে ঢুকে যেতে পারে!
খানিকক্ষণ বিল্ডিংয়ের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে আমরা যখন বের হয়ে আসছি তখন দেখলাম গেটের কাছে একটা মোটর সাইকেল দাঁড় করানো সেখানে পাহাড়ের মতো বড় একজন মানুষ বসে আছে। মানুষটার ওজনে মোটর সাইকেলের চাকা যে ফেটে যাচ্ছে না, সেটাই আশ্চর্য। আরেকজন শুটকো মানুষ সেই একই মোটর সাইকেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একটা কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছে। মানুষগুলোর চেহারার মাঝে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গির মাঝে এমন একটা কিছু আছে যেটা দেখে কেমন যেন অস্বস্তি হয়। দেখেই বোঝা যায় মানুষগুলো ভালো না।
যে মানুষটা কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছিল সে দাঁত খোঁচানো বন্ধ করে আমাদের দিকে তাকালো, তারপর পিচিক করে রাস্তায় থুতু ফেলে বলল, “এই যে খোকারা।”
আমরা মোটেও খোকা না, আমাদেরকে কেউ খোকা বলবে সেটা মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু সেটা নিয়ে তর্ক করা যায় না, তাই তর্ক না করে আমরা দাঁড়ালাম। অনু বলল, “আমাদেরকে বলছেন?”
শুটকো মানুষটা হাসার ভঙ্গি করে বলল, “এইখানে তোমরা ছাড়া আর কে আছে? আর কাকে বলব?”
কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচানোর জন্যেই হোক আর অন্য কোনো কারণেই হোক মানুষটার দাঁতগুলোর মাঝে অনেক বড় ফাঁক। তার মাঝে দিয়ে জিবটাকে দেখা যায়–জিবের মাঝে কালো কালো ফুটকি, এরকম আমি আগে কখনো দেখিনি। মানুষটা তার ফুটকি ফুটকি জিব বের করে সেটা দিয়ে তার ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নিয়ে বলল, “তোমরা এইখানে কেন ঢুকেছ?”
টিটন বলল, “ঢুকলে কী হয়?”
“এইখানে তো কেউ ঢুকে না, তাই জানতে চাচ্ছি। মানুষজন ভয় পায়। তোমরা তো পোলাপান মানুষ, তোমরা কেন ভয় পাও না?”
“মানুষজন কী ভয় পায়?”
“এই তো ভূত-প্রেত!”
টিটন তার শার্টের হাতা তুলে তার বিশাল তাবিজটা দেখিয়ে বলল, “এই যে আমার এই তাবিজটা আছে। ভূত আমার ধারেকাছে আসে না।”
“অ।” মানুষটা আবার কাঠি দিয়ে তার দাঁত খোঁচাতে শুরু করে, দেখে মনে হয় আমাদের সাথে তার কথা বুঝি ফুরিয়ে গেছে। আমরা যেই হাঁটতে শুরু করেছি তখন সে আবার থামাল, “কিন্তু তোমরা তো আমাকে বললে না কেন এইখানে ঢুকেছ।”
আমি একটু অস্বস্তি বোধ করতে থাকি। এই মানুষটি কেন বারবার আমাদের জিজ্ঞেস করছে আমরা কেন ভিতরে ঢুকেছি? মানুষটাকে বিশ্বাস করানোর মতো উত্তর পাওয়া কঠিন। আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই অনু মুখ খুলল, বলল, “ব্যাঙের ছাতা খুঁজতে।”
“কীসের ছাতা?”
“ব্যাঙের ছাতা।”
“ব্যাঙের ছাতা? কেন?”
“আমাদের বিজ্ঞান স্যার আমাদেরকে একটা সায়েন্স প্রজেক্ট দিয়েছেন। ব্যাঙের ছাতার উপর। সেই জন্যে আমাদের ব্যাঙের ছাতা দরকার। কয়দিন থেকে আমরা সব জায়গায় ব্যাঙের ছাতা খুঁজছি। শেষ পর্যন্ত এইখানে পেয়েছি।”
“অ।” মানুষটা আবার তার দাঁত খোঁচাতে থাকে।
“ব্যাঙের ছাতা আসলে এক ধরনের ফাংগাস!” এবারে চঞ্চল যোগ দিল, “আমাদের দেশে অনেক রকম ব্যাঙের ছাতা আছে। অনেক ব্যাঙের ছাতা খাওয়া যায়, যেরকম মাশরুম। সেগুলো চাষও করে। ব্যাঙের ছাতা হওয়ার জন্যে দরকার একটু অন্ধকার, একটু সঁাতসেঁতে জায়গা। অনেক ব্যাঙের ছাতা আছে। খুব বিষাক্ত, কেউ যদি একটু খায় তা হলেই মরে যাবে। অনেক ব্যাঙের ছাতা আছে যেগুলো খেলে মারা যাবে না, কিন্তু নেশা হবে। সেই জন্যে ব্যাঙের ছাতা চেনা দরকার। আমরা সেই জন্যে ব্যাঙের ছাতা নিয়ে গবেষণা করব…”
মোটর সাইকেলের সামনে পাহাড়ের মতোন যে মানুষটা বসে ছিল সে মনে . হয় চঞ্চলের বক্তৃতা শুনে বিরক্ত হয়ে গেল। সে বলল, “আবে মাইনকা। এই প্যাচাল শুনে লাভ নাই। আয় যাই।”
মানুষটি যে রকম মোটা তার গলার স্বর ঠিক সে রকম। শুধু মোটা না তার শরীরটা পাহাড়ের মতো, টাইট একটা টি-শার্ট পরেছে আর সেই টি-শার্টের ভিতর দিয়ে তার শরীরটা বোঝা যাচ্ছে। মনে হয় তার শরীরে মাংশপেশী জীবন্ত প্রাণীর মতো কিলবিল কিলবিল করছে। সে যদি হাত দিয়ে একটা ঝটকা দেয় তা হলে মনে হয় আমরা চারজন চারদিকে ছিটকে পড়ব।