আমাদের কিছুক্ষণ লাগল শান্ত হতে, সবার আগে শান্ত হল টিটন, সে মেঝেতে থাবা দিয়ে বলল, “খুন করে ফেলব আমি। আমাদের ক্লাব হাইজ্যাক করে নিয়ে যাবে? এতো বড় সাহস?”
চঞ্চল কম্পিউটার দিয়ে কম্পোজ করে ছাপানো ফর্মটার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, “দেখেছিস! কী সুন্দর ফর্মটা তৈরি করেছে?”
অনু বলল, “রাতুলেরটাতে কতো বানান ভুল এইটাতে একটা বানান ভুল নাই।”
আমি গরম হয়ে বললাম, “শুধু বানান ভুল না থাকলে আর সুন্দর হলেই হল? আমাদের ক্লাবটা চোট্টামি করে দখল করে নিবে?”
চঞ্চল বলল, “দখল তো করে নাই। তারা তো বলেছে আমরা সবাই মিলে করব–”
টিটন বলল, “কখনো না। ব্ল্যাক ড্রাগনে আমরা ছাড়া আর কেউ থাকতে পারবে না।”
আমি বললাম, “আমি আগে থেকে বলে রাখলাম, যদি ব্ল্যাক ড্রাগনে মিথিলা এসে ঢুকে তা হলে আমি সেখানে নাই। বাসায় আমার জীবন নষ্ট করে ফেলেছে এখন বাইরেও আমার জীবনটাকে নষ্ট করবে? তোরা জানিস মিথিলা কি করে? আমার আম্মুর কাছে দিনরাত কী রকম নালিশ করে তোরা সেটা কোনোদিন শুনেছিস?”
অনু বলল, “ছোট বোনেরা সবসময়েই একটু আহাদী হয়।”
“আহ্লাদী মোটেই না। ডেঞ্জারাস। দেখছিস না ব্ল্যাক ড্রাগনের সবকিছু টুনিকে বলে দিয়েছে? মিথিলা না বললে টুনি কি জানতে পারত?”
“মিথিলা জানল কেমন করে?”
“আমি যখন লিখেছিলাম তখন চুরি করে পড়েছে।”
চঞ্চল ফর্মটার দিকে তাকিয়ে আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কী সুন্দর ফর্মটা তৈরি করেছে দেখেছিস? কম্পিউটার হচ্ছে একটা ম্যাজিক! ইশ! আমার যদি একটা কম্পিউটার থাকত!”
.
চঞ্চল তার পেরিস্কোপ তৈরি শেষ করল বিকেলের দিকে। পেরিস্কোপের সাথে একটা টর্চ লাইট নিয়ে তখন আমরা মিশকাত মঞ্জিলের দিকে রওনা দিলাম। বাচ্চারা বাইরে ছোটাছুটি করছে, তাদের মাঝে মিথিলাও আছে। আমরা টুনিকেও দেখলাম, সে পেয়ারা গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করল, “তোরা কোথায় যাচ্ছিস?”
আমরা প্রথমে না শোনার ভান করলাম, যখন আবার জিজ্ঞেস করল তখন বললাম, “এই তো ওই দিকে!”
আমরা ভয় পাচ্ছিলাম টুনি হয়তো এখন আমাদের সাথে রওনা দেবে, কিন্তু আমাদের খুব কপাল ভালো যে ঠিক তখন তার একটা ফোন এসে গেল। মনে হল জরুরি ফোন কারণ দেখলাম সে হাত-পা নেড়ে কথা বলতে শুরু করেছে আমরা তখন পা চালিয়ে সরে গেলাম। এখন চেষ্টা করলেও আমাদের পিছু নিতে পারবে না।
মিশকাত মঞ্জিলের কাছাকাছি এসে টিটন আবার ঘ্যানঘ্যান শুরু করল, বলল, “আমাদের কী ভেতরে যেতেই হবে? অন্য কোথাও যেতে পারি না?”
“অন্য কোথায়?”
“এই ধর নদীর ধারে কোথাও, না হলে পুকুর ধারে।”
চঞ্চল বলল, “কিন্তু গোপন কুঠুরি তো খালি এখানেই আছে!”
“গোপন কুঠুরি ছাড়া কি অ্যাডভেঞ্চার হয় না?”
“এটা শেষ করে নেই, তারপর দেখা যাবে।”
কাজেই টিটন খুব বিরস মুখে আমাদের পিছু পিছু এলো। আগেরবার যখন এসেছিলাম তখন সময়টা ছিল দুপুর, আলো ছিল অনেক বেশি। আজকে বিকেল হয়ে গেছে তাই গাছের লম্বা লম্বা ছায়া পড়েছে। চারদিকে এক ধরনের ছমছমে ভাব। শুধু টিটন না, আমাদেরও কেমন যেন ভয় ভয় করতে থাকে। আমরা নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে সেই ঘরটাতে যাই। আগের দিন একটা বেজি বের হয়ে এসেছিল, আজকেও কিছু বের হবে কি না বুঝতে পারছিলাম না। আমি দেয়ালটাতে দুটো লাথি দিলাম, যদি কিছু বের হতে চায় তা হলে যেন আগেই বের হয়ে যায়। কিছু বের হল না। তখন চঞ্চল উবু হয়ে ছোট গর্তটা দিয়ে টর্চ লাইটটা ঢুকিয়ে দেয়, ভেতরটা নিশ্চয়ই এখন আলোকিত হয়ে উঠেছে, আমাদের মনে হল ভেতরে ডানা ঝটপট করে কিছু উড়তেও শুরু করেছে।
চঞ্চল তখন সাবধানে তার পেরিস্কোপটা ঢুকিয়ে দেয়, তারপর চোখ লাগিয়ে দেখে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী দেখা যায়।”
“একটা ঘর।”
“কী আছে ঘরের ভেতর?”
“কিছু নাই। বাদুর উড়ছে।”
“বাদুর ছাড়া আর কিছু নাই?”
“দাঁড়া দেখি।” চঞ্চল খানিকক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল। তারপর বলল, “মনে হচ্ছে এখান থেকে একটা সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে।”
“সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে? সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
আমি চঞ্চলকে সরিয়ে বললাম, “দেখি, আমাকে দেখতে দে।”
পেরিস্কোপে চোখ লাগিয়ে ভেতরে দেখা যায় সত্যি কিন্তু কোনটা সোজা কোনটা উল্টো বুঝতে সময় লাগে। খানিকক্ষণ তাকিয়ে আমার মনে হল চঞ্চল ঠিকই বলেছে। সত্যিই একটা সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে। তার মানে এই গোপন কুঠুরিটাতেই রহস্য শেষ না! এখান থেকে রহস্য শুরু। কী সাংঘাতিক ব্যাপার।
টিটন সারাক্ষণ উশখুশ করছিল, “এবারে বলল, অনেক হয়েছে। চল যাই।”
আমরাও তখন উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, “চল।”
যখন মিশকাত মঞ্জিল থেকে বের হয়েছি তখন বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। এখন কী করা যায় সেটা নিয়ে কথা বলতে বলতে আমরা হেঁটে হেঁটে ফিরে আসছিলাম, বাসার কাছে এসে দেখি টুনি তখনো পেয়ারা গাছে বসে আছে।
আমাদের দেখে বলল, “কোথায় গিয়েছিলি?”
আমি বললাম, “এই তো!”
“এই তো মানে কোথায়?”
“এই তো মানে এইখানে।”
টুনি তখন গাছ থেকে নেমে আসে। আমাদের কাছে এসে বলল, “আমি কি বলেছিলাম মনে আছে?”
“কী?”
“আমি তোদের সাথে চিনে জোঁকের মতো লেগে থাকব।”
“মনে আছে।”
“আমি কিন্তু লেগে আছি। তোরা টের পাচ্ছিস?”
টিটন বলল, “না।”