“তা হলে আমি সবাইকে বলে দেব!”
“বলে দেখ, আমি তোর মাথা ভেঙে ফেলব।”
মিথিলা তখন নাকি সুরে কান্নার ভঙ্গি করে বলল, “আম্মু দেখ ভাইয়া আমাকে মারবে!”
আম্মু দুইজনকেই ধমক দিলেন। বললেন, “ব্যস অনেক হয়েছে। দুইজনই থাম–তোদের যন্ত্রণায় আমাদের পাগল হয়ে যাবার অবস্থা।”
আমি নাস্তা করে টেবিল থেকে কাগজগুলো নিয়ে বের হলাম। কালকে রাত জেগে আমি ব্ল্যাক ড্রাগন দলের কাজকর্ম কীভাবে চালানো হবে, সদস্য হতে হলে কীভাবে ফর্ম ফিল-আপ করতে হবে সেগুলো তৈরি করেছি। পুরো কাজটা করেছি গোপনে, কেউ যেন দেখতে না পারে আর পাজী মিথিলাটা সবকিছু পড়ে ফেলেছে। কোনো একদিন আমি মনে হয় মিথিলাকে খুনই করে ফেলব।
চঞ্চলের বাসা আমাদের বাসার খুব কাছে। দোতলায় চিলেকোঠার ঘরটা চঞ্চলের ল্যাবরেটরি, আমি নিচতলায় তাকে খোঁজ না করে সোজা দোতলায় উঠে গেলাম, কারণ আমি জানি চঞ্চল এখন এখানেই থাকবে।
চঞ্চলের দরজাটা খোলা, আমি দেখলাম সে আমার দিকে পিছন ফিরে কাজ করছে। আমার পায়ের শব্দ শুনে মুখ না ঘুরিয়েই বলল, “রাতুল তুই আজকে লাল রঙের শার্ট পরে এসেছিস!”
আমি বললাম, “আমার দিকে না তাকিয়ে কেমন করে বলছিস?”
“এই দেখ।”
আমি কাছে গিয়ে দেখলাম একটা রঙিন টেলিভিশন সেখানে রাতুলের বাসার সিঁড়িটা দেখা যাচ্ছে। আমি যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসেছি তখন নিশ্চয়ই আমাকে এখানে দেখেছে। জিজ্ঞেস করলাম, “টেলিভিশন কোথায় পেলি?”
“বাসার।”
“তোদের বাসার টেলিভিশন তোকে দিয়ে দিয়েছে?”
“দেয় নাই। ঠিক করতে দিয়েছে।”
“তোকে টেলিভিশন ঠিক করতে দিয়েছে?”
চঞ্চল মুখ বাঁকা করে হেসে কী একটা জিনিস টেলিভিশনের উপরে রাখল। সাথে সাথে টেলিভিশনের ছবিটা পেঁচিয়ে কেমন যেন বিদঘুঁটে হয়ে গেল। চঞ্চল আমাকে সেটা দেখিয়ে বলল, “টেলিভিশনের কাছে পাওয়ারফুল চুম্বক ধরলে ছবিটা এরকম হয়ে যায়। আমি তাই করেছি–সবাই ভেবেছে টেলিভিশন নষ্ট হয়ে গেছে! টিভি মেকানিকের কাছে পাঠাবে-” চঞ্চল চোখ নাচিয়ে বলল, “আমি বলেছি আমি ঠিক করে দেব। সেই জন্যে আমাকে দিয়েছে!”
চঞ্চল টেলিভিশনের উপর থেকে চুম্বকটা সরাতেই আবার ছবিটা ঠিক হয়ে গেল। চঞ্চল সেদিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “আমি বলেছি মেকানিককে যত টাকা দিতে হত আমাকে তার অর্ধেক দিলেই হবে। জানি না দিবে কি না!”
চঞ্চলের ফিচলে বুদ্ধি দেখে আমি অবাক হলাম। বৈজ্ঞানিকদের বিজ্ঞানের বুদ্ধির সাথে সাথে নিশ্চয়ই ফিচলে বুদ্ধিও থাকে!
চঞ্চল বলল, “বাইরে থেকে ভিতরের জিনিস দেখার জন্যে যন্ত্রটা তৈরি করেছি–কিন্তু মুশকিল হল এটা আমরা মিশকাত মঞ্জিলে কেমন করে নিব? এতো বড় টেলিভিশন যদি নিয়েও যাই সেখানে তো ইলেকট্রিসিটি নাই। কেমন করে দেখব?”
“তা হলে উপায়?”
“একটা জেনারেটর হলে হত। কিংবা ব্যাটারি দিয়ে চলে সেরকম একটা টেলিভিশন।”
“জেনারেটরের কত দাম!”
“অনেক। আর সেটা চালালে যেরকম ভটভট শব্দ করবে তখন সবাই জেনে যাবে কিছু একটা হচ্ছে।”
“তা হলে?”
চঞ্চল মাথা চুলকে বলল, “আরেকটা হতে পারে একটা রিমোট ক্যামেরা। একটা গাড়ির উপর বসিয়ে সেটা ভিতরে পাঠালাম, সেটাকে বাইরে থেকে কন্ট্রোল করে ছবি তুলোম, তারপর বাইরে নিয়ে এসে ছবিগুলো দেখলাম।”
আমি হাতে কিল দিয়ে বললাম, “গুড আইডিয়া!”
“সেটাই এখন তৈরি করছি। সমস্যা হচ্ছে–”
“কী সমস্যা?”
“ক্যামেরাটা আব্বুর–যদি কিছু একটা হয় তা হলে আব্বু আমাকে খুন করে ফেলবে!”
“ক্যামেরার কী হবে?”
“মনে কর ভিতরে একটা গর্ত, আমার রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি গর্তের ভিতর পড়ে গেল তা হলে তো আর গর্তের ভিতর থেকে বের হতে পারবে না।”
“তা হলে?”
চঞ্চল মুখ কালো করে বলল, “এরকম হাইফাই যন্ত্র ব্যবহার না করে খুব সোজাভাবে দেখা যায়, একটা আয়না আর একটা টর্চ লাইট দিয়ে! কিংবা একটা ছোট পেরিস্কোপ তৈরি করলাম, সেটা দিয়ে ভিতরে দেখলাম। কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
“সেটা তো সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক উপায় হল না! আমি চাচ্ছিলাম খুবই ফাটাফাটি ইলেকট্রনিক্স রিমোট কন্ট্রোল ওয়ারলেস এইরকম কিছু একটা তৈরি করতে!”
এই হচ্ছে আমাদের চঞ্চল–যে কাজটা সোজাভাবে করা যায় সেই কাজটাও কঠিনভাবে করবে! কে জানে বৈজ্ঞানিকেরা মনে হয় এ রকমই হয়। আমি চঞ্চলকে উৎসাহ দেওয়ার জন্যে বললাম, “এইবারে সোজাভাবে করে ফেল। আয়না আর টর্চ লাইট দিয়ে। পরেরবার ফাটাফাটি ইলেকট্রনিক্স দিয়ে করিস।”
চঞ্চল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে।”
এরকম সময়ে আমরা টেলিভিশনে দেখলাম টিটন আর অনু সিঁড়ি দিয়ে আসছে। তাদের হাতে একটা চিপসের প্যাকেট, আমরা দেখলাম তারা দুজন সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পুরো প্যাকেটটা খেয়ে শেষ করল তারপর চিপসের প্যাকেটটা ফেলে দিয়ে মুখ মুছে উপরে উঠতে শুরু করল। কতো বড় নিমকহারাম, আমাদের যেন দিতে না হয় সে জন্যে পুরোটা খেয়ে শেষ করে উপরে উঠছে!
একটু পরেই আমরা তাদের দুজনকে দরজায় দেখলাম। টিটন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “রাতুল! তোদের বাসায় গিয়েছিলাম। খালাম্মা বললেন তুই এইখানে।”
“হ্যাঁ। আমি এইখানে। ব্ল্যাক ড্রাগনের কাজ করার জন্যে সকালবেলা চলে এসেছি।”
দুইজনে ভিতরে ঢুকে টেলিভিশনটা দেখে অবাক হয়ে বলল, “টেলিভিশন? নাটক দেখাচ্ছে না কি?”