টিটন বলল, “ওদের বাসার বিড়ালটাও বই পড়তে পারে।”
চঞ্চল বলল, “যে কোনো জিনিসের বানান জিজ্ঞেস করলে বলে দিতে পারে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করে দেখ। কিংকর্তব্যবিমূঢ় কিংবা মাগৃতিবিকৃতি”
অনু বলল, “মাগৃতিবিকৃতি কোনো শব্দ নাই।”
“ঐ হল! বোঝানোর জন্যে বলেছিলাম।” আমি বললাম, “অনুর সব কবিতা মুখস্থ। পৃথিবীর সব কবিতা।” অনু লজ্জা পেয়ে বলল, “ধুর! মিথ্যা কথা বলবি না।”
“মিথ্যা কথা?” আমি বললাম, “ঐ যে ভীত কুকুর পালিয়ে যায় সেই কবিতাটা পুরাটা তোর মুখস্থ না?”
“এবার ফিরাও মোরে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পুরাটা মুখস্থ নাই।”
টুনি বলল, “শোনাও দেখি কতোটুকু মুখস্থ আছে?”
অনু বলল, “গাছের ডালে বানরের মতো ঝুলে ঝুলে কবিতা আবৃত্তি করা যায় না কি!”
টুনি বলল, “আবৃত্তি করতে হবে না–মুখস্থ বলে যাও।”
অনু জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
টুনি বলল, “দেখব কতোটুকু মুখস্থ।”
অনু বলল, “খুব তাড়াতাড়ি বলি?”
“বল।”
অনু তখন ঝড়ের মতো এক নিশ্বাসে কবিতাটা মুখস্থ বলতে থাকে। বেচারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যদি এটা দেখতেন তা হলে মনে হয় একটু মন খারাপ করতেন। তার কবিতাটা একজন এভাবে সাপের মন্ত্রের মতো টানা বলে যাচ্ছে–মন খারাপ তো হতেই পারে। এই কবিতাটার মাঝে যখন অনু ধামকি দিয়ে পথকুকুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে” অংশটুকু বলেছে তখন টুনির টেলিফোনটা আবার বাজল, ফোনটা ধরেই টুনি চিৎকার করে বলল, “টুশি তুই চিন্তাও করতে পারবি না আমি এখন কোথায়!”
টুনি নিশ্চয়ই অনুমান করে বলার চেষ্টা করেছে সে কোথায়, কিন্তু কোনোটাই হল না, তখন টুনি চিৎকার করে বলল, “আমি একটা গাছের উপর! সত্যিকারের গাছ! চারদিকে ছোট ছোট বিন্দি বিন্দি পেয়ারা। ইচ্ছা করলেই ছিঁড়তে পারি!”
এই জিনিসটা কেন এতো উত্তেজনার আমরা ঠিক বুঝতে পারলাম না, কিন্তু মনে হল টুনি এবং টুশি দুজনেই এটা নিয়ে খুব উত্তেজিত। একটু পরেই টুশি নিশ্চয়ই টুনির কাছে জানতে চাইল”আজিব” ছেলেগুলোর কী খবর, কারণ শুনলাম টুনি বলছে, “ও হ্যাঁ। আজিব ছেলেগুলো আছে আমার কাছেই, আমি ওদের সাথেই গাছে বসে আছি! হা হা, ওরা আসলেই আজিব। তবে খারাপভাবে আজিব না ভালোভাবে আজিব। একজন হচ্ছে সায়েন্টিস্ট খালি আবিষ্কার করে। আরেকজনের পুরা সঞ্চয়িতা মুখস্থ। একেবারে গুলির মতো মুখস্থ বলে যায়। টুশি তুই বিশ্বাস করবি না জায়গাটা কতো সুন্দর, চারদিকে গাছপালা, সেইখানে.আবার সত্যিকারের পাখি। আমাদের বাসার সামনে বিশাল মাঠ, এক মাথা থেকে অন্য মাথা দেখা যায় না এতো বড়! এখানে কোনো গাড়ি নাই, ট্রাফিক জ্যাম নাই। বাতাস পরিষ্কার। নিশ্বাস নিলে মনে হয় পরিষ্কার বাতাস দিয়ে ফুসফুসটা ধুয়ে ফেলছি। তুই একবার আয়, দেখলে ট্যারা হয়ে যাবি?”
টুনি অনেকক্ষণ ফোনে কথা বলে শেষ পর্যন্ত ফোনটা রাখল, রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটার ঢাকার জন্যে মন খারাপ হচ্ছে। টেলিফোনে বন্ধুর কাছে বানিয়ে বানিয়ে এই জায়গাটা নিয়ে ভালো ভালো কথা বলছে, কিন্তু আসলে যারা বড় শহরে থাকে তারা কখনো ছোট জায়গায় এসে ভালো থাকে না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “টুশি তোর বন্ধু?”
“ওর নাম টুশি না। ওর নাম তাসনুভা। আমি আমার নামের সাথে মিলিয়ে টুশি ডাকি।”
“ও।“
আমরা আরো কিছুক্ষণ গাছে বসে রইলাম। একটু পর আরো বাচ্চা-কাচ্চারা বের হয়ে ছোটাছুটি করতে লাগল তখন আমরা গাছ থেকে নেমে এলাম। টুনিকে একজন নতুন মানুষ দেখে সবাই আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। মিথিলাও ছুটতে ছুটতে এলো, বলল, “আপু, তুমি ভাইয়াদের সাথে গাছে উঠে বসেছিল? সর্বনাশ! তুমি জান ভাইয়ারা কি করে? আর কখনো ওদের সাথে মিশবে না! তোমার মাথার উপরে বিষ পিঁপড়া দিয়ে দিবে। আমার নাম মিথিলা। ক্লাস সিক্সে পড়ি। পি. কে. গার্লস স্কুল। তুমি কোন ক্লাসে পড়? আগেই বল না, আমি আন্দাজ করি। ক্লাস সেভেন। হয়েছে? কোন স্কুলে পড়বে তুমি? প্লীজ প্লীজ তুমি আমাদের স্কুলে ভর্তি হবে। প্লীজ প্লীজ। তোমার নাম কী আপু? দাঁড়াও দাঁড়াও আগেই বল না, আমি আন্দাজ করি। তোমার নাম নিতু। হয় নাই? তা হলে প্রিয়াংকা? হয় নাই? মিলি? হয় নাই? লীনা? হয় নাই?”
আমার টুনির জন্যে মায়া লাগতে থাকে!
.
০৪.
সকালে আমি গপ গপ করে নাস্তা করছি তখন আম্মু বললেন, “কী হল? তোর এতো তাড়াহুড়া কীসের? ট্রেন ধরবি না কি? আস্তে আস্তে খা।”
আমি বললাম, “আস্তে আস্তেই তো খাচ্ছি।” বলে আবার গপ গপ করে খেতে থাকি।
।মিথিলা বলল, “আমি জানি ভাইয়া কেন এতো তাড়াতাড়ি খাচ্ছে।”
আমি সোজা হয়ে বসে বললাম, “তুই কী জানিস?”
মিথিলা তখন সুর করে বলল, “ব্ল্যাক-ড্রা-গ-ন!”
আমি রেগে বললাম, “তুই আমার কাগজগুলো দেখেছিস? কেন তুই আমার কাগজ দেখবি? আমার পারমিশন না নিয়ে তুই কেন আমার কাগজ দেখলি?”
মিথিলা খুব বোকা বোকা চেহারা করে বলল, “আমি তো বুঝি নাই এটা দেখা যাবে না। তুমি তো কাগজের উপর লিখে রাখ নাই এটা দেখা যাবে না।”
“তুই যদি কাউকে এটার কথা বলিস তা হলে আমি তোর মাথা ভেঙে ফেলব।”
“আমাকে তোমাদের ব্ল্যাক ড্রাগন দলে নাও তা হলে কাউকে বলব না!”
“কী?” আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “তুই ব্ল্যাক ড্রাগন হবি? ইশ! সখ দেখে বাঁচি না।”