“যতক্ষণ ঠাট্টা ততক্ষণ ঠাট্টা। যখন সিরিয়াস তখন সিরিয়াস।”
কথাটার মানে কী আমরা কেউই ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমরা হাঁটতে হাঁটতে আমাদের বাসার কাছে যে পেয়ারা গাছটা আছে তার কাছে চলে এসেছি। মেয়েটাকে খুব ভদ্রভাবে খসিয়ে দেওয়ার উপায় হচ্ছে পেয়ারা গাছটাতে উঠে বসে থাকা। মেয়েটা তখন তো আর নিচে থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আমাদের সাথে কথা চালিয়ে যেতে পারবে না। খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে চলে যাবে। তাই আমরা আর কথা না বাড়িয়ে পেয়ারা গাছে উঠে গেলাম। আমি টিটন আর চঞ্চল সহজেই গাছে উঠতে পারি। অনুকে নিচে থেকে একটু ঠেলতে হয়। টুনি নামের মেয়েটাকে দেখানোর জন্যে আজকে অনু নিজেই হাচর-পাঁচর করে উঠে গেল।
মেয়েটা নিচে থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে, তার চোখ দুটোতে কেমন যেন আনন্দের ছায়া পড়ল। খুশি খুশি গলায় বলল, “কী মজা! তোরা সত্যিকার গাছে উঠে বসে থাকিস! এটা কী গাছ? আম গাছ না কি?”
মেয়েটা পেয়ারা গাছ পর্যন্ত চেনে না। আমি বললাম, “না, এটা পেয়ারা গাছ।”
“কী মজা! ঢাকা শহরে কোনো গাছ নাই। খুব বেশি হলে লাইটপোেস্ট আছে। আমি উঠি?”
আমরা চমকে উঠলাম, বলে কী মেয়েটা? চঞ্চল জিজ্ঞেস করল, “তুমি আগে কখনো গাছে উঠেছ?”
“উঠি নাই তো কী হয়েছে? সবকিছুরই তো প্রথমবার আছে।”
আমি বললাম, “পড়ে ব্যথা পেলে কিন্তু আমাদের দোষ দিও না।”
“ভয় নাই। দিব না।” বলে মেয়েটা গাছটা ধরে বেশ তরতর করে বানরের মতো গাছে উঠে গেল। উপরে উঠে সে একেবারে বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে ওঠে, “একদম সোজা! আমি চিন্তাও করি নাই গাছে উঠা এতো সোজা! আর গাছের উপর থেকে সবকিছু দেখতে কী মজা লাগে দেখেছিস?”
আমরা চারজন মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমাদের এতো সুন্দর পরিকল্পনাটা এভাবে মাঠে মারা যাবে একবারও চিন্তা করিনি। শুধু যে মাঠে মারা গেছে তা না বরং উল্টো দিকে কাজ করেছে। লাভের বদলে হয়েছে ক্ষতি।
টুনি গাছে পা ঝুলিয়ে বসে বলল, “তোদের সাথে যখন প্রথম দেখা হল তখন ভেবেছিলাম তোদের যখন মেয়েদের নিয়ে এতো এলার্জি তা হলে তোরা থাক তোদের মতো। আমি থাকব আমার মতো। পরে মনে হল কেন এতো সহজে তোদের ছেড়ে দিব? জোর করে তোদর মাঝে ঢুকে যাব। এটা হবে আমার একটা প্রজেক্ট।”
“প্রজেক্ট?” চঞ্চল জিজ্ঞেস করল, “কীসের প্রজেক্ট?”
“মনে কর আমি ব্লগ লিখতে পারি আমি মেয়ে বলে কীভাবে চারজন ছেলে আমাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে কিন্তু আমি চিনে জোঁকের মতো লেগে থেকে এক সময় তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছি!”
আমি আপত্তি করে বলতে চাইলাম যে আমরা”ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছি, কথাটা ঠিক না। টিটন বলতে চাইল যে টুনি নেতৃত্ব গ্রহণ করবে বিষয়টা এতো সোজা না, অনু বলতে চাইল যে গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলতে হলে সেখানে চিনে জোঁকের উদাহরণ দেওয়া ঠিক না কিন্তু চঞ্চলের মতো শান্ত-শিষ্ট মানুষ প্রায় চিৎকার করে বলল, “তুমি ব্লগ লিখ?”
“মাঝে মাঝে লিখি।”
চঞ্চল প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, “তোমার কম্পিউটার আছে?”
“পুরান-ধুরান ভাঙাচুরা একটা ডেস্কটপ আছে। মাঝে মাঝে হার্ড ড্রাইভ থেমে যায় তখন জোরে লাথি দিতে হয়, তখন আবার চলে। ভাইরাসে ভাইরাসে বোঝাই।”
চঞ্চল চোখ বড় বড় করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, আমরা বুঝতে পারলাম যে টুনির সবকিছু মাফ করে দিয়েছে! কয়দিন পর দেখা যাবে চঞ্চল আমাদের ফেলে দিয়ে টুনির বাসায় তার কম্পিউটারের সামনে পড়ে আছে। আমি টিটন আর অনু বোকার মতো তাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম, তারা কী নিয়ে কথা বলছে সেটাই বুঝতে পারছি না। বেইজ্জতি আর কাকে বলে!
চঞ্চলের কম্পিউটার না থাকতে পারে কিন্তু তার ঘর বোঝাই যে কতো রকম যন্ত্রপাতি সেটা টুনিকে বলা দরকার, তা না হলে সে মনে করতে পারে আমরা সবাই বুঝি আলতু-ফালতু মানুষ। অন্যের কম্পিউটারের দিকে হ্যাংলার মতো তাকিয়ে থাকি। আমি তাই বললাম, “আমাদের চঞ্চল কিন্তু অনেক বড় সাইন্টিস্ট!
টুনি ভুরু কুঁচকে বলল, “সাইন্টিস্ট।”
চঞ্চল লজ্জা পেয়ে বলল, “ধুর! ফাজলেমি করবি না!”
“মোটেও ফাজলেমি করছি না। চঞ্চলের অনেকগুলো আবিষ্কার আছে। তুই যদি তার ল্যাবরেটরি ঘরটা দেখিস ট্যারা হয়ে যাবি।”
কথাটা শেষ করেই আমি বুঝতে পারলাম আমিও এখন টুনিকে তুই বলা শুরু করেছি!
অনু আর টিটন দুইজনই মাথা নাড়ল। অনু বলল, “একটা টেলিস্কোপ তৈরি করেছে সেটা দিয়ে চাঁদ দেখলে মনে হবে তুই চাঁদটা ছুঁতে পারবি! এতো কাছে।”
টিটন বলল, “প্রত্যেক মাসে চঞ্চল কিছু না কিছু আবিষ্কার করে।“ সে উৎসাহের চোটে বলেই ফেলল, “আমাদের গুপ্তধন খোঁজার জন্যে একটা যন্ত্র বানাবে, সেটা দিয়ে বাইরে থেকে ভিতরের জিনিস দেখা যাবে। তাই নারে?”
আমি কনুই দিয়ে টিটনকে খোঁচা দিয়ে ফিসফিস করে বললাম, “এইটা গোপনীয় কথা। কাউকে বলার কথা না। গাধা কোথাকার।”
টিটনের মনে পড়ল এবং জিবে কামড় দিল। টুনি কিছু না বুঝে এদিক সেদিক তাকিয়ে বলল, “কী হয়েছে? গুপ্তধন? কীসের গুপ্তধন?”
আমরা সবাই একসাথে মাথা নাড়লাম, “কিছু না। কিছু না।”
টুনি বুঝে গেল আমরা বলতে চাচ্ছি না তাই সে আমাদের চাপ দিল না, কিন্তু মুখ দেখে বোঝা গেল তাকে বলিনি দেখে তার একটু মন খারাপ হয়েছে। আমি কথাটা ঘোরানোর জন্যে বললাম, “আর আমাদের অনু হচ্ছে বিশাল সাহিত্যিক। লক্ষ লক্ষ বই পড়েছে।”