“আর যদি না যাই?” এই প্রথম মেয়েটা কথা বলল, গলার স্বরটাও বরফের মতো ঠাণ্ডা।
আমি কী উত্তর দেব বুঝতে পারলাম না। আমতা আমতা করে বললাম, “মানে না যেতে চাইলে আসতে পার। কিন্তু তুমি যদি চাও তা হলে আমরা আমাদের পরিচিত মেয়েদের তোমার কথা বলতে পারি, তারা মনে করো বিকালের দিকে আসতে পারে–”
ঠিক তখন টেলিফোনের শব্দ হল, আর মেয়েটা পকেট থেকে একটা মোবাইল ফোন বের করে ফোনটা ধরল। এইটুকুন পুঁচকে মেয়ে তার আবার মোবাইল টেলিফোন আছে! মেয়েটা বলল, “হ্যালো। টুশি। তোকে পরে ফোন করব। এখন খুবই একটা মজার ব্যাপার ঘটেছে। খুবই আজিব।”
অন্য পাশ থেকে যে ফোন করছে, টুশি না কে সে মনে হয় জানতে চাইল ‘আজিব’, ঘটনাটা কী? মেয়েটা তখন সেটা একটু ব্যাখ্যা করল, “আজিব মানে হচ্ছে কী, আমাদের বাসায় চারটা ছেলে এসেছে। তিনটা টিংটিংয়ে একটা একটু ভোটকা। এসে আম্মুকে জিজ্ঞেস করেছে–” মেয়েটা তখন টিটনের গলার স্বরটা নকল করে নাকি গলায় বলল, “খালাম্মা আপনাদের বাসায় কী কোনো ছেলে
চেঁলে আছে? আমি কিন্তু শুনেছি ছেলেমেয়ে বলে নাই বলেছে ছেলে-টেলে। আম্মু তো বোকা-সোকা মানুষ ধরেই নিয়েছে ওরা বলেছে ছেলেমেয়ে। তাই আমাকে জোর করে ওদের সাথে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি ওদের সাথে হাঁটছি। খুবই আজিব ব্যাপার। মনে হচ্ছে ওরা কোনোদিন কোনো মেয়ে দেখে নাই কথা বলা তো দূরের কথা! চারজনেই চূড়ান্ত নার্ভাস, একেবারে ঘেমে-টেমে যাচ্ছে। তোকে পরে সব বলব।”
মেয়েটা লাইন কেটে দিয়ে ফোনটা পকেটে রেখে আমাদের দিকে তাকাল, বলল, “হ্যাঁ, কী যেন বলছিলে?” ভাব-ভঙ্গি একেবারে বড় মানুষের মতো।
মেয়েটার কথা শুনে রাগের চোটে আমার কানের গোড়া পর্যন্ত গরম হয়ে গেছে। আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম, “তুমি মেয়ে সেই জন্যে আমরা মোটেও নার্ভাস না। আমরা অনেক মেয়ে দেখেছি।”
চঞ্চল বলল, “আমাদের ক্লাসের অর্ধেকের বেশি মেয়ে।”
অনু বলল, “আর আমরা যে মেয়েদের চিনি তারা খুবই ভালো। তারা খুবই সুইট। তারা কাউকে টিংটিংয়ে ডাকে না, কাউকে ভোটকাও ডাকে না।”
টিটন বলল, “তুমি মেয়ে বলে বেঁচে গেছ। ছেলে হলে এই রকম খারাপ খারাপ কথা বলার জন্যে পিটিয়ে তক্তা করে দিতাম। নতুন এসেছ বলে খাতির করতাম না।”
মেয়েটা খুবই মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনল তারপর মাথা নেড়ে বলল, “তা হলে দোষটা আমার? আমিও তা হলে বলতে পারি আমি অনেক ছেলেদের চিনি তারা কেউ আমাকে ডেকে এনে বলে না তুমি মেয়ে, তোমাকে আমাদের দরকার নেই। তুমি চলে যাও।”
আমি বললাম, “আমি ঠিক এইভাবে বলি নাই।”
“বলেছ।”
“আমি অনেক ভদ্রভাবে বলেছি।”
“খারাপ কথা ভদ্রভাবে বললে ভালো হয়ে যায় না। খারাপই থাকে।”
অনু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “তুমি আমাকে ভোটকা বলেছ।”
মেয়েটাকে এই প্রথমবার একটু কাচুমাচু দেখাল, বলল, “আমি সরি। তোমরা শুনে ফেলবে আমি বুঝি নাই। আর বলব না। আর মনে রাখ তোমরাও বলেছ আমাকে পিটিয়ে তক্তা বানাবে। আমি সেটা শুনে ভয় পাই না, কিন্তু তোমরা সেটা আমাকে বলেছ।”
চঞ্চল এবারে বড় মানুষের মতো বলল, “ঠিক আছে ঠিক আছে। দুই পার্টিই ভুল করেছে। ভুলে ভুলে কাটাকাটি।”
টুনি নামের মেয়েটা রাজি হল। বলল, “ঠিক আছে ভুলে ভুলে কাটাকাটি।”
চঞ্চল বলল, “তুমি চাইলে আমাদের সাথে আসতে পার। আমার আপু আছে, রাতুলের বোন মিথিলা আছে তাদের সাথে তোমাকে কথা বলিয়ে দেই। তুমি তাদের সাথে গল্প করতে পারবে, খেলতে পারবে।”
“আগে হলে হয়তো তাই করতাম। এখন দেরি হয়ে গেছে।”
চঞ্চল জিজ্ঞেস করল, “কীসের দেরি হয়ে গেছে?”
“এই যে তোরা আমাকে খসানোর চেষ্টা করছিস! আমি খসব না। আমি চিনে জোঁকের মতো তোদের সাথে লেগে থাকব।”
মেয়েটার কথা শুনে আমরা এতো অবাক হলাম যে, সে আমাদের তুই করে বলতে শুরু করেছে সেটা পর্যন্ত খেয়াল করলাম না। আমি আমতা আমতা করে বললাম, “চি-চিনে জোঁকের মতো?”
“হ্যাঁ। আমি অবশ্যি কখনো চিনে জোঁক দেখি নাই। শুধু বইয়ে পড়েছি যে মানুষ চিনে জেঁকের মতো লেগে থাকে। এখানে কি চিনে সেঁক আছে?”
চঞ্চল মাথা নাড়ল, “আছে।”
“ঢাকা শহরে কোনো চিনে জোঁক নাই। আসলে ঢাকা শহরে তেলাপোকা আর মশা ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী নাই।”
আমি লক্ষ করলাম মেয়েটা অন্য কথা বলে আসল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছে। আমি তাকে আসল বিষয়ে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলাম, “তুমি আমাদের সাথে চিনে জেঁকের মতো লেগে থাকবে?”
“হ্যাঁ।”
“আমরা ছেলেরা যেগুলো করি সেইগুলো তোমার ভালো না লাগলেও তুমি আমাদের সাথে থাকবে?”
“হ্যাঁ।”
“আমরা যদি তোমাকে দলে নিতে না চাই তা হলেও তুমি আমাদের দলে ঢুকতে চাইবে?”
“হ্যাঁ।”
“আমরা যদি তোমাকে এড়িয়ে চলি? তোমার কথার উত্তর না দেই? তোমাকে পাত্তা না দেই? খারাপ ব্যবহার করি? অপমান করি? তা হলে? তা হলে কী করবে?”
“অনেক কিছু করার আছে। সোজাটা বলব না কঠিনটা বলব?”
“সোজাটা শুনি।”
মেয়েটা তার পকেট থেকে টেলিফোন বের করে সেটাকে একটু টিপাটিপি করে একটা নম্বর বের করে আমাদের দেখাল। বলল, “এখানে কী লেখা আছে? পড়।”
আমরা পড়লাম, ইভটিজিং হট লাইন। মেয়েটা বলল, “আমি এই নম্বরে ফোন করে বলব চারটা ছেলে আমাকে ইভটিজিং করছে। তখন তারা পুলিশকে ফোন করবে। পুলিশ ফোন করবে র্যাবকে। তারপর পুলিশ আর র্যাব মিলে এসে তোদের কাঁক করে ধরে নিয়ে যাবে।” মেয়েটা দাঁত বের করে হাসল, আর আমরা দেখলাম সে যখন হাসে তখন তাকে দেখতে বেশ ভালো মানুষের মতোই দেখায়। এরকম একটা ডেঞ্জারাস মেয়ে এরকম ভালো মানুষের মতো হাসতে পারে আমার সেটা নিজের চোখে দেখে বিশ্বাস হতে চাইল না। আমি বললাম, তুমি আমাদের সাথে ঠাট্টা করছ, তাই না?”