মাসুদ ভাই এখন অনেক ভালো ভালো কথা বলতে লাগল, কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম আমাকে আসলে নেবে না, সে জন্য এত ভালো ভালো কথা বলছে! আমার এত মন খারাপ হলো যে চোখে পানি এসে গেল। অন্ধকার বলে মাসুদ ভাই দেখতে পেল না।
আমি একা একা কালী গাংয়ের তীর ধরে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরে এলাম।
.
মাসুদ ভাই ঠিকই বলেছিল, মুক্তিবাহিনীর এই মহড়ার পর মিলিটারির খুব দরকার না হলে ক্যাম্প থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। রাজাকারদের উৎপাতও কমে গেল। মাসুদ ভাই মতি রাজাকারকে এমন ভয় দেখিয়েছিল, যে সে একেবারে সিধে হয়ে গেল। তার রাইফেলটা মুক্তিবাহিনীরা নিয়ে গিয়েছিল বলে মিলিটারিরা তাকে আরেকটা রাইফেল দিয়েছে (তার আগে শুনেছি মিলিটারি তাকে কঠিন শাস্তি দিয়েছে!) এখন সে খুবই মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। এতজন মানুষের সামনে মাসুদ ভাইয়ের পা ধরে মাফ চেয়ে কোনোভাবে জান বাঁচিয়েছে সেটার জন্য তার খুব বেইজুতি হয়েছে। লতিফা বুবুকে বিয়ে করার চিন্তা এখন তার মাথায় নাই, মুখ দেখানোর উপায় নাই, বিয়ে করার চিন্তা করে কেমন করে?
আমি লতিফা বুবুকে তার ইঁদুর মারার বিষ কিনে দেয়ার টাকা ফেরত দিতে গিয়েছিলাম। লতিফা বুবু নেয় নাই, বলেছে, এটা তোর। তুই জিলাপি কিনে খাস।
এক টাকার জিলাপি আমি একা খেয়ে শেষ করতে পারব মনে হয় না।
.
১৮.
কয়দিন থেকে ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। এত বৃষ্টি যে মনে হচ্ছে আকাশ বুঝি ভেঙে পড়ছে। অন্য সময় এত বৃষ্টি হলে আমার মনে হয় একটু মেজাজ খারাপ হতো, এইবারে তা হচ্ছে না। বৃষ্টি মানেই পাকিস্তান মিলিটারির সমস্যা, বৃষ্টি মানেই মুক্তিবাহিনীদের সুবিধা। মুক্তিবাহিনীদের অস্ত্র নৌকা করে আনে, বর্ষার সময় নদীতে যখন অনেক পানি থাকে তখন অস্ত্র আনা-নেয়ার অনেক সুবিধা।
আমি আর ডোরা মাঝে মাঝেই বৃষ্টির মাঝে বের হই। ডোরাকে অবশ্য এখন ডোরা না ডেকে খোকন ডাকাই ভালো, কারণ সে সত্যি সত্যি চুল ছোট করে শার্ট-প্যান্ট পরে খোকন হয়ে গেছে। বাড়ির কয়েকজন ছাড়া অন্যরা তাকে খোকন বলেই জানে! বের হওয়ায় সময় হাতে একটা ছাতা থাকে। একটু পরেই ছাতা গুটিয়ে আমরা বৃষ্টিতে ভিজি। বৃষ্টিতে ভিজতে অবশ্যি ডোরার আগ্রহই বেশি। শহরে থাকে বলে আগে এ রকম বৃষ্টিতে ভিজে ছপছপ করে কাদার ভেতর দিয়ে কখনো হাঁটেনি। তা ছাড়া এগুলো সব হচ্ছে ডোরার মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং সে এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করে সে মুক্তিবাহিনীতে যাবে।
সেদিন মুক্তিবাহিনীর দল গ্রামের ভেতর দিয়ে যখন হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিল তখন সে খবর পায়নি বলে নিজের চোখে দেখতে পায়নি, সেটা নিয়ে তার আফসোসের সীমা নাই। তার সবচেয়ে দুঃখ যে সুলেমান আর মতি রাজাকারকে কীভাবে মাসুদ ভাই একটা উচিত শিক্ষা দিয়েছে, সেটা সে নিজের চোখে দেখতে পারল না। তাই যখনই ডোবার সাথে আমার দেখা হয় আমার পুরো গল্পটা বলতে হয়। আমি গল্পটাতে অনেক রংচং লাগিয়ে বলি আর সেটা শুনে ডোরা হাসতে হাসতে মারা যায়।
আজকেও আবার পুরো গল্পটা বলতে হলো, ডোরা তখন জিজ্ঞেস করল, সুলেমান কি পুরো ইয়াহিয়া খানের ছবিটা খেয়ে শেষ করেছিল?
ঠিক তখন মতি রাজাকারকে ধরে এনেছিল বলে কেউ সুলেমানের দিকে নজর দেয়নি তাই কেউ সেটা লক্ষ্য করেনি কিন্তু আমি সেটা বলে গল্পের মজা নষ্ট করলাম না। আমি বললাম, শেষ করে নাই মানে! পুরো ছবিটা খেয়ে পেছনের কার্ডবোর্ডটা খেয়েছে, তারপর ছবির ফ্রেমটা চাবাতে শুরু করেছিল।
আর মতি রাজাকার? মতি রাজাকার মাসুদ ভাইয়ের পা ধরে কী করল?
আমি তখন বাড়িয়ে-চাড়িয়ে বললাম, পুরো জুতোর তলাটা চেটে চেটে পরিষ্কার করল।
সত্যি?
সত্যি না তো মিথ্যা নাকি! মাসুদ ভাই কত কাদা গোবর মাড়িয়ে এসেছে, জুতার নিচে কত ময়লা সব চেটে খেয়ে ফেলল!
ডোরা বলল, ইয়াক থু! তারপর হি হি করে হাসতে লাগল। বৃষ্টিতে ভিজে কাদার ওপর খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে আমরা কালী গাং পর্যন্ত গেলাম। কালী গাংয়ে অনেক পানি এসেছে, ঘোলা পানিতে অনেক স্রোত, পানি পাক খেতে খেতে যাচ্ছে, দেখলে একটু ভয় ভয় করে। আমার বাবা আর মা মনে হয় এ রকম একটা স্রোতের মাঝে নৌকা ডুবে মারা গিয়েছিলেন।
আমরা অনেকক্ষণ কালী গাংয়ের তীরে দাঁড়িয়ে থাকলাম, যখনই একটা নৌকা যাচ্ছিল তখনই আমরা বলছিলাম, এইটা নিশ্চয়ই মুক্তিবাহিনীর নৌকা! কিংবা এইটাতে বোঝাই করে নিশ্চয়ই অস্ত্রপাতি নিয়ে যাচ্ছে। তারপর কী কী অস্ত্র নিয়ে যাচ্ছে সেগুলোর নাম বলতে শুরু করলাম। আমি একটার নাম বললাম তখন ডোরা আরেকটার নাম বলল। এইভাবে দুইজনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল রাইফেল, স্টেনগান, মেশিনগান, এসএলআর, গ্রেনেড, মর্টার এই সব শেষ হয়ে গেলে আমি বললাম কিল!
ডোরা বলল, কিল কি আবার অস্ত্র নাকি?
একশবার অস্ত্র। একটা মিলিটারিকে ধরে আনলে সবাই কিলিয়ে ভর্তা বানিয়ে ফেলবে না?
ঠিক আছে। ডোরা হাসতে হাসতে রাজি হয়ে গেল। তারপর বলল, ঘুষি।
আমি বললাম, চড়।
ডোরা বলল, থাপ্পর।
খামছি।
চিমটি। এভাবে বলতেই থাকল আর আমরা বোকার মতো হাসতেই থাকলাম।
যখন বৃষ্টিটা কমছে তখন আমি আর ডোরা বাড়ি ফিরে যেতে শুরু করলাম। ডোরা হঠাৎ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুই আমাকে একটা কথা দে।