.
আজকাল আমি রাত করে বাড়ি ফিরে আসি, নানি কিছু বলে না। আমার দিকে কেমন করে জানি তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে আমরা স্কুলে সবার সাথে কলাপাতা বিছিয়ে খেয়ে আসি, বাড়ি এসে নানিকে বলি, নানি আজকে খেতে হবে না। স্কুল থেকে খায়া আসছি।
নানি জিজ্ঞেস করে কী খাইছিস?
আমি বলি, ভাত আর ডাল।
আর কিছু না?
নাহ।
ডিমের সালুন রাঁধছি। খাবি আরেকটু?
আমি সাথে সাথে রাজি হয়ে যাই। কী কারণ জানি না আজকাল খেতে খুবই ভালো লাগে, খালি খেতে ইচ্ছে করে, দিন-রাত রাক্ষসের মতো খাই। আমি একা না অন্যদেরও দেখি এই অবস্থা। সবাই শুধু খায়। নানি আমাকে ভাত বেড়ে দিল, আমি আবার রাক্ষসের মতো খেলাম, কে বলবে আমি একটু আগে খেয়ে এসেছি। খাওয়ার সময় নানি সব সময় আমার পাশে বসে সূবাইকে গালমন্দ করে, আজকে দেখি কিছু করল না, আমার পাশে বসে বসে আমাকে খেতে দেখল। মাসুদ ভাইকে জিজ্ঞেস করতে হবে যুদ্ধ শুরু হবার পর হঠাৎ করে খিদে এত বেড়ে গেল কেন!
ভোরবেলা স্কুলে যাচ্ছি তখন ফালতু মতির সাথে দেখা হলো। মতি জানে আমি কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, তার পরও জিজ্ঞেস করল, কই যাস?
স্কুলে। ঢাকা শহর থেকে প্রত্যেক দিন শত শত মানুষ আসছে, কাঁকনডুবি গ্রামের সবাই মিলে তাদেরকে স্কুলে খেতে দিচ্ছে, শুতে দিচ্ছে কিন্তু এর মাঝে মতিকে কোনো দিন দেখি নাই। তাই আমি জানি আমি স্কুলে যাচ্ছি শুনেই মতি নিশ্চয়ই তার ঠোঁটটা বাঁকা করে টিটকারি দিয়ে একটা বাজে কথা বলবে। আমি সেটা শোনার জন্য অপেক্ষা করে থাকলাম কিন্তু কী আশ্চর্য মতি টিটকারি দিয়ে কিছু বলল না। বরং গম্ভীর মুখে বলল, গেরামের মানুষ খুবই ভালো একটা কাজ করতেছে। বিপদে পড়া মানুষদের সাহায্য করছে। খুবই সওয়াবের কাজ।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি যাবা মতি ভাই?
মতি মাথা নাড়ল, বলল, নাহ্। সব তো মালাউন, মালাউনদের খেদমত করে কী হবে?
আমি অবাক হয়ে বললাম, মালাউন?
হ্যাঁ। মালাউনরা কপালের সিঁদুর মুছে হাতের শাঁখা খুলে যাচ্ছে যেন বোঝা না যায়। মালাউনদের পিছলা বুদ্ধি!
মতির কথা শুনে আমি খুবই অবাক হলাম, হিন্দুরা কেন কপালের সিঁদুর মুছে ফেলবে? হাতের শাখা খুলবে? আমি কথা না বাড়িয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছিলাম, তখন পেছন থেকে মতি বলল, তা ছাড়া মালাউনদের সাহায্য করলে কোনো সওয়াব নাই। মুসলমানদের সাহায্য করলে সওয়াব আছে।
আমি কোনো কথা না বলে স্কুলের দিকে হাঁটতে লাগলাম। স্কুলে অনেক ভিড়। যারা গত রাতে এসেছে তাদের অনেকে আজকে চলে যাচ্ছে। যাবার সময় আমরা তাদেরকে বড় সড়কে তুলে দিই। আমরা কাজে লেগে গেলাম। আমি দেখলাম, মতি আসলে ভুল কথা বলে নাই। বেশ কয়েকজন মহিলার কথা শুনে বোঝা যায় তারা হিন্দু কিন্তু তারা কপালের সিঁদুর মুছে ফেলেছে। হাতে শাখা নাই। কী আশ্চর্য। কারণটা কী, কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
মাসুদ ভাই খুবই ব্যস্ত, তাকে জিজ্ঞেস করতে পারলাম না, তাই বিকালবেলা বলাই কাকুর চায়ের স্টলে বলাই কাকুকে জিজ্ঞেস করলাম। বলাই কাকু প্রশ্নটা শুনে একটা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর বলল, ইয়াহিয়া খান বলছে এই সব হচ্ছে ইন্ডিয়ার কারসাজি। মুসলমানদের দেশ পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলার জন্য হিন্দুদের ষড়যন্ত্র।
তাই বলেছে?
হ্যাঁ। সেই জন্য মিলিটারির সবচেয়ে বেশি রাগ হিন্দুদের ওপর। হিন্দুদের ওপর আর আওয়ামী লীগের ওপর। পাকিস্তান মিলিটারি যেখানে আওয়ামী লীগ পাচ্ছে আর হিন্দু পাচ্ছে, সবাইকে মেরে ফেলছে। এই জন্য যারা হিন্দু তাদের কেউ কেউ নিজের পরিচয় গোপন রাখছে।
কিন্তু এইখানে তো পাকিস্তান মিলিটারি নাই, এইখানে ভয় কী?
এইখানে কোনো ভয় নাই। কিন্তু রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে, রাস্তাঘাটে কত রকম মানুষ আছে, তাদের কেউ যদি–
আমি বললাম, কিন্তু, কিন্তু—
কিন্তু কী সেটা জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। একটু পরে জিজ্ঞেস করলাম, বলাই কাকু, বঙ্গবন্ধু সবাইকে ঠিকমতো অর্ডার দেয় না কেন?
বলাই কাকু কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বঙ্গবন্ধুকে মিলিটারিরা তো অ্যারেস্ট করে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গেছে।
আমি চিৎকার করে বললাম, না! নেয় নাই। আমি নিজে শুনেছি–
বলাই কাকু মাথা নিচু করে তার ছোট ছোট চায়ের গ্লাসগুলো ধুতে ধুতে বলল, সব পত্রিকায় ছবি ছাপা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছে। বিবিসি থেকে বলেছে।
আমি আবার বললাম, কিন্তু, কিন্তু–আমি আবার কিন্তু কী, সেটা জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। হঠাৎ করে আমার মনটা এত খারাপ হলো যে বলার না। আমাকে দেখে নিশ্চয়ই বলাই কাকুর মায়া হলো। তাই বলাই কাকু আমাকে বেশি করে দুধ-চিনি দিয়ে চা বানিয়ে দিল। সাথে একটা কুকি বিস্কুট। আজকাল খেতে আমার এত ভালো লাগে, যা কিছু পাই গপগপ করে খেয়ে ফেলি, তার পরও কুকি বিস্কুটটা চায়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খেতে অনেকক্ষণ লেগে গেল।
লতিফা বুবুর বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখলাম, বাংলাঘরের পাশে লতিফা বুবু দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে হাত নেড়ে ডাকল, এই, রঞ্জু!
আমি এগিয়ে গেলাম। লতিফা বুবু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোর মুখ এত শুকনা কেন? কী হইছে?
বঙ্গবন্ধুরে পাঞ্জাবিরা অ্যারেস্ট করেছে।