“জি আপা।”
বোতলের পানি বিক্রি করার সময় পানি না বলে কেন এটাকে মিনারেল বলতে হয় জালাল সেটা ভালো করে জানে না। কিন্তু এই আপা যদি এইটাকে পানি বললেই কিনতে রাজি হয় সেটাকে পানি বলতে তার কোনো আপত্তি নেই।
ইভার ব্যাগে ছোট একটা পানির বোতল ছিল তারপরেও সে জালালের কাছ থেকে এক বোতল পানি কিনে নিল। ভেজাল পানি।
.
ট্রেন আসার আগে আরো অনেক বাচ্চা হাজির হল, ইভা ধৈর্য ধরে সবাইকে একটা করে দুই টাকার নোট দিল। তার ব্যাগে সবসময় দুই টাকার নোটের একটা বান্ডিল থাকে, কোথাও সে পড়েছে এই নোটের ডিজাইনটা না কী একটা পুরস্কার পেয়েছে। সেই জন্যে এটা সে সাথে রাখে।
ট্রেনে ওঠার সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষ ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “কাজটা ঠিক করলেন না।”
ইভা থতমত খেয়ে বলল, “কোন কাজটা?”
“এই যে সব বাচ্চাগুলোকে দুই টাকা করে ভিক্ষা দিলেন। এদের অভ্যাস নষ্ট করে দিলেন।”
“অভ্যাস নষ্ট করে দিলাম?”
“হ্যাঁ। এদেরকে ভিক্ষা করতে শিখালেন।”
“আমি ভিক্ষা করতে শিখালাম?”
মানুষটা ফোঁস করে আরেকটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “এই দেশে এই রকম রাস্তাঘাটের বাচ্চা কলোজন আপনি জানেন?”
এইটা সত্যিকারের প্রশ্ন না তাই ইভা কিছু বলল না। মানুষটা বলল, “আপনি দুই টাকা করে দিয়ে এদের সমস্যা মিটাতে পারবেন না। এইটা কোনো সমাধান না।”
ইভা এবারে মানুষটার দিকে তাকাল। মানুষটা লম্বা, মাথার সামনের দিকে চুল নেই, ঝাঁটার মতো গোঁফ। চেহারা দেখে মনে হয় এই মানুষটার নিজের উপর খুব বিশ্বাস, মানুষটার ধারণা সে সবকিছু জানে আর সে যে কথাটা বলেছে সেটাই হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র সত্যি কথা। মানুষটা চাইছে ইভা কিছু একটা বলুক, আর তখন সে আরো নতুন উৎসাহে ইভার সাথে তর্ক শুরু করবে। তাই ইভা কিছু বলল না, ছোট বাচ্চারা অর্থহীন কথা বললে বড়রা তাদের দিকে তাকিয়ে যেভাবে হাসে সেভাবে মানুষটার দিকে তাকিয়ে হাসল, তারপর বলল, “আপনি ঠিক বলেছেন!” তারপর তাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের সিটটা খুঁজে বের করে বসে পড়ল। চোখের কোনা দিয়ে তাকিয়ে দেখল মানুষটা কেমন যেন হতাশ হয়ে তাকিয়ে আছে-তর্ক করার এরকম একটা সুযোগ পেয়েও একজন মানুষ যে তর্ক না করেই বসে যেতে পারে মনে হয় মানুষটা বিশ্বাস করতে পারছে না।
.
পরের সপ্তাহে বৃহস্পতিবার দুপুরবেলা আবার ইভা স্টেশনে এসে হাজির হল। আবার সে তার ছোট ব্যাগটা হাতে নিয়ে এক নম্বর প্লাটফর্মে হাঁটছে তখন আবার সে তার কনুইয়ে ঠাণ্ডা একটা হাতের স্পর্শ টের পেল। ঘুরে তাকিয়ে দেখে লাল রুক্ষ চুলের সেই ছোট মেয়েটি। ময়লা একটা গেঞ্জি হাঁটু পর্যন্ত চলে এসেছে। ফোকলা দাঁত দিয়ে বাতাস বের করে বলল, “আফা। দুইটা টেহা দিবেন?”
ইভা বাচ্চাটার দিকে তাকাল। বলল, “কী খবর মায়া?”
মায়া চমকে ওঠে এবং হঠাৎ করে সে ইভাকে চিনে ফেলল, সাথে সাথে সে তার সবগুলো ফোকলা দাঁত বের করে হাসল বলল, “দুই টেহি আফা!”
“কী আপা?”
“দুই টেহি। আফনি সবাইরে দুই টেহা দেন হের লাগি আফনি দুই টেহি আফা!”
ইভা বড় বড় চোখে মায়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “আমি দুই টেকি আপা?”
মায়া মাথা নাড়ল। ইভা তখন তার ব্যাগ থেকে দুটি টাকা বের করে মায়াকে দিল। মায়া চকচকে নতুন নোটটা হাতে নিয়ে একবার তার গালে চুঁইয়ে হাতের অন্যান্য টাকার সাথে রেখে দিল। গতবারের মতো মায়া আজকে সাথে সাথে চলে গেল না, কাছে দাঁড়িয়ে ইভাকে ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। একটু পরে বলল, “আফা। আপনার শাড়িটা কয় টেহা?”
ইভা একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল, শাড়িটা সে বছর খানেক আগে অনেক দাম দিয়ে কিনেছে কিন্তু এই বাচ্চাটাকে সেটা বলার কোনো যুক্তি নেই। তাই মাথা নেড়ে বলল, “জানি না। এটা তো আমাকে একজন দিয়েছে তাই কত দাম জানি না।”
“কে দিছে? আফনের জামাই?
ইভা হেসে ফেলল, বলল, “না, আমার জামাই নাই। অন্য একজন দিয়েছে।”
“আফনের শাড়িটা অনেক সোন্দর।”
ইভা বলল, “থ্যাংক ইউ।”
মায়া সাথে সাথে হি হি করে হাসতে থাকে। ইভা অবাক হয়ে বলল, “কী হল? হাস কেন?”
মায়া হাসতে হাসতে বলল, “আফনে আমারে কন থ্যাংকু।”
এর মাঝে কোন অংশটা হাসির ইভা ঠিক বুঝতে পারল না কিন্তু সেটা নিয়ে সে মাথাও ঘামাল না। মায়ার ফোকলা দাঁতের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কী জান, তোমার সামনে দাঁত নাই।”
মায়া সাথে সাথে ঠোঁট দিয়ে তার মুখটা বন্ধ করে ফেলল। তার ভঙ্গি দেখে মনে হল দাঁত না থাকাটা খুবই লজ্জার একটা ব্যাপার আর সেটা কোনোভাবেই কাউকে দেখানো যাবে না।
মায়া বলল, “তোমার দাঁত কেমন করে পড়ল? মুখ হা করে ঘুমিয়েছিলে আর ইঁদুর এসে খেয়ে ফেলেছে?”
মায়া মুখ বন্ধ রেখেই জোরে জোরে মাথা নেড়ে অস্বীকার করল কিন্তু ইভা চারপাশ থেকে হাসির শব্দ শুনতে পেল। সে লক্ষ করেনি বেশ কয়েকজন বাচ্চা এর মাঝে আশেপাশে দাঁড়িয়ে তাদের কথাবার্তা শুনছে এবং ঘুমের মাঝে ইঁদুর এসে দাঁত খেয়ে ফেলার বিষয়টা তাদের সবারই খুব পছন্দ হয়েছে। একজনে হাতে কিল দিয়ে বলল, “ইন্দুরে খাইছে, ইন্দুরে খাইছে! আমি দেখছি হে মুখ হা কইরা ঘুমায়।”
ইভা বলল, “তুমি এতো খুশি হচ্ছ কেন? তুমি যখন ছোট ছিলে তোমারও তো দাঁত ছিল না! তুমিও নিশ্চয়ই মুখ হা করে ঘুমিয়েছিলে!”