ওস্তাদ বলল, “আমার ফ্যাক্টরি নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। আমার সমস্যা কোন জায়গায় জানিস জাল্লাল?”
“কুন জায়গায়?”
“মার্কেটিং। যদি ঠিকমতো মার্কেটিং করতে পারতাম তা হলে এততদিনে ঢাকার মালিবাগে একটা ফ্ল্যাট থাকত।”
বিষয়টা জালাল ঠিক বুঝল না কিন্তু সেটা নিয়ে সে মাথা ঘামাল না, ওস্তাদের কথায় মাথা নেড়ে সায় দিল।
ওস্তাদ বলল, “তয় মার্কেটিংয়েও কিছু সমস্যা আছে।”
“কী সমিস্যা?”
“বেশি মার্কেটিং মানে বেশি মানুষ। আর বেশি মানুষ মানে বেশি জানাজানি। জানাজানি যদি একটু ভুল জায়গায় হয় তা হলেই আমি ফিনিস।”
জালাল আবার বুঝে ফেলার ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল, বলল, “অ।”
ওস্তাদ সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, “সেই জন্যে আমি দুই চারজন বিশ্বাসী মানুষ ছাড়া আর কাউরে আমার বিজনেসের কথা বলি না।”
জালাল ওস্তাদের দুই-চারজন বিশ্বাসী মানুষের মাঝে একজন সেটা চিন্তা করেই গর্বে তার বুক ফুলে উঠল।
.
জালাল একেবারে সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত ওস্তাদের বাসায় থাকল। ওস্তাদ তাকে দিয়ে কিছু টুকটাক কাজ করিয়ে নিল। সে ঘরদোর একটু পরিষ্কার করল, ওস্তাদের সিগারেটের গোড়া, কলার ছিলকে, চিপসের খালি প্যাকেট বাইরে ফেলে এল। মোড়ের টিউবওয়েল থেকে এক বালতি পানি এনে দিল। বিকালবেলা চা নাস্তা খাওয়ার জন্যে চায়ের দোকান থেকে লিকার চা আর ডালপুরি কিনে আনল।
ওস্তাদ তার হাতের কাজ শেষ করে জালালের পলিথিনের ব্যাগের ভেতরের পানির খালি বোতলগুলো বুঝে নিল। তার বদলে ওস্তাদ তাকে এক ডজন পানির বোতল দিল। হাফ লিটারের বোতল, ঠিক করে বিক্রি করতে পারলে তার একশ টাকা নিট লাভ!
ওস্তাদকে সালাম দিয়ে জালাল ঘর থেকে বের হয়ে আসে। ঘরের দরজার কাছে বসে কুক্কু খুব মনোযোগ দিয়ে বিদ্ঘুটে একটা হাড় চিবাচ্ছিল। হাড়টাতে খাওয়ার কিছু নেই, মনে হয় সময় কাটানোর জন্যে এটা কামড়াচ্ছে। কোথা থেকে এই বিদ্ঘুটে হাড় খুঁজে বের করেছে কে জানে। জালালকে পানির বোতলের প্যাকেট নিয়ে বের হতে দেখে কুক্কু তার হাড় ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ল।
স্টেশনে ফিরে আসার সময় আবার সেই একই কাহিনী। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাস্তান কুক্কুরেরা তাদের এলাকা পাহারা দিচ্ছে। কুক্কু তাদের সাথে মারামারি করতে করতে ফিরে আসছে। মারামারিতে জিততে পারলে কাছাকাছি লাইটপোস্টে পা তুলে সে একটুখানি পেশাব করে পুরো কুকুর বাহিনীকে অপমান করার চেষ্টা করছে।
ওস্তাদের বাসায় যাবার সময় ছিল হালকা খালি পাস্টিকের বোতল। এখন ফিরে যাবার সময় পানি ভরা বোতল। বোতলগুলো অনেক ভারি–একটা রিকশা নিতে পারলে হত কিন্তু জালাল রিকশা নিয়ে পয়সা নষ্ট করল না। টাকা-পয়সা রোজগার করা যে কথা, খরচ না করে বাঁচিয়ে ফেলা সেই একই কথা। অনেকদিন থেকে সে টাকা জমানোর চেষ্টা করছে।
.
রাত গম্ভীর হলে মজিদ তার বাড়ি চলে গেল, সে স্টেশনের কাছেই টিএন্ডটি বস্তিতে থাকে। মতির মা তার কাজ শেষ করে বাড়ি যাবার সময় মতিকে নিয়ে গেল। অন্য যারা আছে তাদের বাড়িও নেই মা-বাবার খোঁজও নেই, তারা স্টেশনেই থাকে। এটাই তাদের বাড়ি-ঘর। এখানে তারা নিজেরাই একজন আরেকজনের বাবা-মা ভাই বোন সবকিছু। তারা এমনিতে সবসময় একজন আরেকজনের সাথে ঝগড়াঝাটি মারপিট করছে কিন্তু তারপরেও কীভাবে কীভাবে জানি একজন আরেকজনের উপর নির্ভর করে। স্টেশনে নানারকম বিপদ-আপদ, মাঝে মাঝে গভীর রাতে পুলিশ এসে তাদেরকে মারধোর করে তাড়িয়ে দেয়। ফেনসিডিল, হেরোইন খাওয়া কিছু খারাপ মাস্তান আছে মাঝে মাঝে তারা হামলা করে তাদের টাকা-পয়সা কেড়ে নেবার চেষ্টা করে। সবাই একসাথে থাকলে এই রকম বিপদ-আপদ কম হয়। কিংবা যখন হয় তখন সেটা সামাল দেওয়া যায়।
শেষ ট্রেনটা চলে যাবার পর তারা সবাই গুটিশুটি মেরে শুয়ে গেল। জালাল একপাশে তার মাথার কাছে কুক্কু। শাহজাহান একটু বিলাসী তার একটা ময়লা কাঁথা পর্যন্ত আছে। জেবা আর মায়া দুইজন একজন আরেকজনকে জড়াজড়ি করে ধরে শুয়ে আছে। প্রাটফর্মের শেষ মাথায় সিঁড়ির নিচে কাউলা আর তার মায়ের সংসার। প্লাটফর্মে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে আছে কিছু ভিখিরি, থুরথুরে একজন বুড়ি, একজন লম্বা চুল-দাড়িওয়ালা সন্ন্যাসী। এমনিতে সারাদিন স্টেশনে থাকে না কিন্তু রাতে ঘুমানোর জন্যে শহর থেকে বেশ কিছু মানুষ আসে। তাদের কারো কারো চেহারা ভালো মানুষের মতো আবার কেউ কেউ ষণ্ডা ধরনের, লাল চোখ দেখে ভয় লাগে।
জালাল কুক্কুকে জড়িয়ে ধরে একসময় ঘুমিয়ে গেল। গভীর রাতে হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে যায়। কেন ভেঙেছে সে জানে না। তার মনে হল সে একটা কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। কিছুক্ষণ কান পেতে শুনে বোঝার চেষ্টা করল তারপর উঠে বসল। মনে হয় জেবা। জালাল উঠে বসল, তার ধারণা সত্যি। জেবা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কান্নার সাথে সাথে তার শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। জালাল জিজ্ঞেস করল, “জেবা। কী হইছে, কান্দস ক্যান?”
সাথে সাথে জেবার কান্নার শব্দ থেমে গেল। জালাল আবার ডাকল, “জেবা।”
জেবা বলল, “উঁ।”
“কান্দস ক্যান?”
জেবা সহজ গলায় বলল, “কে কইছে কান্দি? কান্দি না।” একটু থেমে যোগ করল, “মনে হয় খোয়াব দেখছি।”