জালালের হাতে কয়েকটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল। তার কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে যে জরিনি খালা নামের এই মহিলাটা জেবা আর মায়াকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে? কেন যাচ্ছে?
দেখতে দেখতে ট্রেনটা এত জোরে ছুটতে শুরু করল যে জালাল বুঝতে পারল সে আর কিছু করতে পারবে না। তার নিজের ভেতরে হঠাৎ এক ধরনের ভয় কাজ করতে শুরু করে। এখন কী হবে? মায়ার কী হবে? জেবার কী হবে?
হঠাৎ জালালের কী হল কে জানে সে হাত থেকে তার পানির বোতলগুলো ফেলে দিয়ে ট্রেনের সাথে সাথে ছুটতে থাকে। সে অসংখ্যবার চলন্ত ট্রেনে উঠেছে, অসংখ্যবার চলন্ত ট্রেন থেকে নেমেছে কিন্তু এতো জোরে ছুটতে থাকা ট্রেনে কখনোই ওঠেনি। কেউ কখনো উঠতে পেরেছে কি না সে জানে না।
জালাল মাথা থেকে সব চিন্তা দূর করে পাগলের মতো ছুটতে থাকে, প্লটফর্ম শেষ হবার আগে তার এই ট্রেনে উঠতে হবে, একবার প্লাটফর্ম শেষ হয়ে গেলে আর সে উঠতে পারবে না। ছুটতে ছুটতে সে একটা খোলা দরজার হ্যাঁন্ডেলের দিকে তাকাল, সে যদি হ্যাঁন্ডেলটা একবার ধরতে পারে তা হলেই শেষ একটা সুযোগ আছে। একবার চেষ্টা করল, পারল না, জালাল তবু হাল ছাড়ল না। সে শুনতে পেল ট্রেনের ভেতর থেকে মানুষজন চিৎকার করছে, “কী কর? কী কর? এই ছেলে? মাথা খারাপ না কি?”
জালাল কিছু শুনল না, ছুটতে ছুটতে আরেকবার চেষ্টা করে হ্যাঁন্ডেলটা ধরে ফেলল। হাতটা ফস্কে যেতে যাচ্ছিল কিন্তু জালাল ছাড়ল না। তার পা দুটি তখনো পাটফর্মে, প্রাণপণে সে প্লাটফর্মের উপর দিয়ে ছুটে যেতে থাকে। এবারে লাফ দিয়ে তার পা দুটো পাদানিতে তুলতে হবে, পাদানিতে পা তোলার আগ পর্যন্ত শরীরের পুরো ভারটুকু থাকবে তার হাতের উপর। তখন যদি হাত ফসকে যায় তা হলে সে সোজা ট্রেনের চাকার নিচে চলে যাবে।
অনেক মানুষ চিৎকার করছে, জালাল তার কিছুই শুনল না। সে হ্যাঁন্ডেলটা দুই হাতে শক্ত করে ধরে রেখে একটা লাফ দিল এবং পা দুটো সে পাদানিতে তোলার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। জালালের পা শূন্যে ঝুলে যায়, সে হাতে একটা হ্যাঁচকা টান অনুভব করল, আর সাথে সাথে তার সারা শরীরটা একটা বস্তার মতো ঘুরপাক খেয়ে বগির দেয়ালে প্রচণ্ড জোরে আছড়ে পড়ল, ট্রেনের ভেতর থেকে সে অসংখ্য মানুষের আর্তচিৎকার শুনতে পেল।
জালাল তখন হ্যাঁন্ডেলটা ধরে বিপজ্জনকভাবে ঝুলছে। সে ঝুলতে ঝুলতে তার পা দুটি পাদানিতে রাখার চেষ্টা করে। কানের খুব কাছে দিয়ে একটা সিগন্যাল লাইটের পোস্ট বের হয়ে গেল, আরেকটু হলে সেটাতে ধাক্কা খেয়ে সে নিচে ছিটকে পড়ত। প্রথমবার পাদানিতে পা রাখতে পারল না, তখন সে ঝুলে থাকা অবস্থায় আবার চেষ্টা করল, এবারে একটা পা রাখতে পারল–সাথে সাথে জালালের বুকে পানি আসে, সে হয়তো এ যাত্রা রক্ষা পেয়ে গেছে। খুব সাবধানে সে তার অন্য পা-টাও পাদানিতে রেখে দুই পায়ের উপর ভর দিল–একটু আগে মনে হচ্ছিল হাতটা ছিঁড়ে যাচ্ছে, আর বুঝি সে ঝুলে থাকতে পারবে না, সেই ভয়ংকর অনুভূতিটা দূর হবার পর জালাল বুঝতে পারে বুকের ভেতর তার হৃৎপিণ্ডটি ধক ধক করে শব্দ করছে এবং এই প্রথম সে ট্রেনের প্যাসেঞ্জারদের চিৎকার আর গালাগালি শুনতে পায়। তার শার্টের কলার ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে একজন তাকে ভেতরে তুলে আনে তারপর চুলের মুঠি ধরে তার গালে রীতিমতো একটা চড় বসিয়ে দেয়, চিৎকার করে বলে, “বদমাইসের বাচ্চা! আরেকটু হলে ট্রেনের চাকার নিচে চলে যেতি, সেইটা জানিস?”
জালাল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, সে এটা জানে। কিন্তু মায়া আর জেবাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে জানতে হলে তার এটা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না। যতক্ষণ সবাই মিলে তাকে বকাবকি করল ততক্ষণ সে মাথা নিচু করে সেগুলো শুনে গেল। সবাই মিলে রাগারাগি করলেও এই রাগারাগির ভেতরে কোথায় জানি তার জন্যে একটুখানি মমতা আছে, বিপদ থেকে সে বেঁচে গিয়েছে সেই জন্যে একটা স্বস্তি আছে তাই গালাগালটুকু সে একেবারেই গায়ে মাখল না। যখন গালাগাল একটু কমে এল তখন সে আস্তে করে সরে পড়ল।
সে এখন মায়া, জেবা কিংবা জরিনি খালার চোখে পড়তে চায় না। তারা এই ট্রেনে আছে এটা সে জানে, তারা কোথায় নামে, কোথায় যায় সেটা সে জানতে চায়। খুব সাবধানে সে সামনের বগির দিকে এগিয়ে যায়। মাঝামাঝি একটা বগিতে সে মায়া, জেবা আর জরিনি খালাকে খুঁজে পেল। তারা তিনজন একটা ট্রেনের সিটে বসেছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে টিকেট কিনে এই সিটে বসতে হয়েছে। জরিনি খালা মোবাইল টেলিফোনে কথা বলছে। জেবা আর মায়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে-মুখে একটু একটু ভয় আর একটু একটু উত্তেজনার ছাপ।
জালাল সেই বগি থেকে সরে এসে ঠিক আগের বগিতে বাথরুমের সামনের খোলা জায়গাটাতে গুটিশুটি মেরে বসে রইল। যখনই ট্রেনটা কোথাও থামে সে উঁকি মেরে দেখে জরিনি খালা মায়া আর জেবাকে নিয়ে নেমে পড়ছে কী না। যখনই ট্রেন থামছে তখনই জরিনি খালা স্টেশনের ফেরিওয়ালার কাছ থেকে মায়া আর জেবাকে চিনাবাদাম, ঝালমুড়ি এইসব কিনে কিনে দিচ্ছিল কিন্তু কেউ ট্রেন থেকে নামল না।
ট্রেনটা যখন শেষ পর্যন্ত ঢাকা পৌঁছাল তখন জরিনি খালা মায়া আর জেবাকে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল। জরিনি খালা এক হাতে একটা কালো ব্যাগ, অন্য হাতে মায়ার হাত ধরে ভিড় ঠেলে এগুতে থাকে–জেবা তাদের পিছু পিছু যেতে থাকে। গেটে টিকেট কালেক্টরকে টিকেট দেখিয়ে তিনজন বের হয়ে এলো। জালালের মতো রাস্তার বাচ্চাদের কাছে কেউ কখনো টিকেট চায় না–সে ভিড়ের সাথে বের হয়ে এল। একটু দূর থেকে জালাল তিনজনকে অনুসরণ করতে থাকে, স্টেশনের অনেক মানুষের মাঝেও সে তাদের চোখে চোখে রেখে এগুতে থাকে।