মায়া কথা না বলে থরথর করে কাঁপতে থাকে। জেবা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “কী হইছে?”
“মাইরা ফালাইছে।”
“মাইরা ফালাইছে? কে মাইরা ফালাইছে? কারে মাইরা ফালাইছে।”
“সবুজ ভাইরে।” বলে মায়া হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
কুক্কু দাঁড়িয়ে জালালের দিকে তাকিয়ে দুইবার ডাকল, জালালের মনে হল কুক্কু স্পষ্ট করে বলল, “আমি তোমারে রাত্রেই বলছিলাম। আমার কথা তুমি বিশ্বাস করলা না।”
প্লাটফর্মে শুয়ে থাকা অনেকে তখন উঠে রেল লাইন ধরে দৌড়াতে থাকে। আউটার সিগন্যালের কাছে একটা ছোট ঝোঁপের পাশে সবুজ পড়ে আছে। তার জিন্সের প্যান্ট, লাল শার্ট, টেনিস সু এমনকি হাতের ঘড়িটাও আছে। সবুজের পড়ে থাকার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায় যে সে বেঁচে নেই।
জালাল ভয়ে ভয়ে একটু কাছে যায়, ঠোঁটের কোনায় একটু রক্ত শুকিয়ে আছে। চোখগুলো আধখোলা। সেই আধখোলা চোখে কোনো প্রাণ নেই-কী ভয়ংকর সেই প্রাণহীন দৃষ্টি! কুক্কু কাছে গিয়ে সবুজকে শুকলো তারপর আকাশের দিকে মুখ তুলে একবার ডাকল। এ ছাড়া আর কেউ কোনো কথা বলল না।
.
সবাই একটু দূরে মাটিতে চুপচাপ বসে থাকে। কী করবে তারা কেউ বুঝতে পারছে না। আস্তে আস্তে একজন দুইজন বড় মানুষ এসে হাজির হতে থাকে, চাপা গলায় নিজেদের ভেতর কথা বলছে। কী হয়েছে কেন সবুজকে মেরে ফেলেছে কেউ বুঝতে পারছে না। শুধু জালাল জানে কী হয়েছে, কিন্তু সে কাউকে এটা বলতে পারবে না। হেরোইন ব্যবসায়ীরা সবুজের ব্যবসার কথা টের পেয়ে গেছে। সবুজের খুব তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়ার ইচ্ছা ছিল, এই রকম ইচ্ছা মনে হয় খুবই ভয়ংকর। তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়া যদি এতো সোজা হত তা হলে মনে হয় সবাই বড়লোক হয়ে যেত। সেই জন্যে মনে হয় পৃথিবীতে বড়লোক মানুষ বেশি নাই, সেই জন্যেই মনে হয় অনেক মানুষকে প্লাটফর্মে ঘুমাতে হয়।
পুলিশের লোক এসে চাটাই দিয়ে মুড়িয়ে সবুজের শরীরটা না নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত জালাল, জেবা, মায়া, মজিদ তারা সবাই সেখানে বসে থাকে। আন্তঃনগর জয়ন্তিকা এসে গেল আবার চলেও গেল, আজকে কেউ সেই ট্রেনে গিয়ে ছোটাছুটি করল না।
.
দুপুরের দিকে মজিদ খবর আনল বিকালবেলা সবুজের লাশ কাটাকুটি করার জন্যে লাশকাটা ঘরে আনবে। মায়া চোখ কপালে তুলে বলল, “ক্যান? লাশ কাটাকুটি করবি ক্যান?”
মজিদ গম্ভীর হয়ে বলল, “মার্ডার হলি লাশ কাটতি হয়। দেখতি হয় কেমনি
মার্ডার হল আগেই যে আবার কাটা
একদিন আগেই যে পুরোপুরি একজন মানুষ ছিল এখন সে শুধু যে একটা লাশ তাই নয়–সেই লাশ আবার কাটাকুটি করা হবে চিন্তা করেই সবাই কেমন জানি মন মরা হয়ে যায়।
মজিদ বলল, “বেওয়ারিশ লাশ। মনে অয় হাসপাতালে বিক্রি করি দিবি।”
মায়া জিজ্ঞেস করল, “বেওয়ারিশ কী?”
জেবা বলল, “যেই লাশের কুনো মালিক নাই সেই লাশ হইল বেওয়ারিশ।”
“লাশের মালিক ক্যামনি অয়?”
“মা বাপ ভাই বুন হইল মালিক। যার মা বাবা ভাই বুন নাই, তার লাশের কুনো মালিক নাই।”
মায়া চিন্তিত মুখে তাকিয়ে থাকে, এই স্টেশনে যারা থাকে তাদের কারোই মা বাবা ভাই বোন নাই, থাকলেও তাদের খোঁজ নাই। তার মানে তার চারপাশে যারা আছে তারা সবাই বেওয়ারিশ?
জালাল মজিদকে জিজ্ঞেস করল, “লাশকাটা ঘরে যাবি?”
মজিদ প্রথমে একটু অবাক হল তারপর মাথা নেড়ে বলল, “যামু।”
জেবা বলল, “আমিও যামু।”
মায়া বলল, “আমিও।”
কিছুক্ষণের মাঝেই স্টেশনের বাচ্চাদের ছোট একটা দল লাশকাটা ঘরের দিকে রওনা দিল। দলটার সামনে কুক্কু এবং কুকুর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল সে খুব ভালো করে জানে কোথায় যেতে হবে এবং সবাইকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
সবার একটা ধারণা ছিল যে লাশকাটা ঘরটা হবে ফাঁকা একটা মাঠের মাঝখানে ঝোঁপঝাড় গাছপালা দিয়ে ঢাকা ছোট একটা অন্ধকার ঘর। কিন্তু খোঁজ খবর নিয়ে তারা যে জায়গায় হাজির হল সেটা সরকারি হাসপাতাল। সাদা রঙের একটা বিল্ডিংয়ের একপাশে একটা একতলা বিল্ডিং না কী লাশকাটা ঘর। আশেপাশে আরো বিল্ডিং, সেখানে মানুষজন যাচ্ছে আসছে দেখে মনেই হয় না এইখানে একটা লাশকাটা ঘর থাকতে পারে। বিল্ডিংয়ের সামনে একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, জালাল সাহস করে পুলিশটাকে জিজ্ঞেস করল, “এইখানে কি আমাগো সবুজের লাশ কাটব?”
পুলিশটা ভালো করে তার কথা শুনলই না, খেঁকিয়ে উঠে বলল, “যা বদমাইশের বাচ্চা। ভাগ।”
|||||||||| কুক্কু কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সেটা পুলিশের দিকে তাকিয়ে রাগি রাগি গলায় চাপা একটা শব্দ করল, সেটা শুনে মনে হয় পুলিশটাও একটু ভয় পেল। তখন জেবা এগিয়ে এসে ক্যাটক্যাটে গলায় বলল, “আফনেরে একটা জিনিস জিগাই তার উত্তর দেন না কিল্লাই। আমাগো ভাই মরছে আমাগো দুঃখু অয় না?”
পুলিশটা কিছুক্ষণ জেবার দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর বলল, “কী জিজ্ঞেস করলি?”
জালাল বলল, “সবুজ ভাইয়ের লাশ এইখানে কাটব?”
পুলিশ ভুরু কুঁচকিয়ে বলল, “স্টেশনে যেটা মার্ডার হয়েছে?”
“জে।”
“তার নাম সবুজ? তোরা চিনিস?”
“জে।”
“কেমন করে মারা গেছে তোরা জানিস?”
সবাই মাথা নেড়ে বলল তারা জানে না। পুলিশটার তখন তাদের নিয়ে সব কৌতূহল শেষ হয়ে গেল। সে খুব যত্ন করে নাকের একটা লোম ছিঁড়ে বলল, “হ্যাঁ। ছেলেটার এইখানে পোস্টমর্টেম হচ্ছে।”
ওরা পোস্টমর্টেম বলে এই ইংরেজি শব্দটা আগে কখনো শুনেনি কিন্তু বুঝে গেল এটার মানে হচ্ছে লাশ কাটা। মায়া হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, “সবুজ ভাইয়ের লাশরে কয় টুকরা করব?”