আপু আর ভাইয়া একবার টাকাগুলি দেখলো তারপর আমার দিকে তাকালো। আপু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ছিঃ! তপু। ছিঃ! আপুর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো আমি যেন এখনি মরে যাই।
আম্মু টাকাগুলো হাতে তুলে নিলেন, তারপর বেল্টটা হাতে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমি আম্মুর মুখের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত মৃত্যু দেখতে পেলাম। আম্মু যখন আমার আমাকে মারতে শুরু করলেন আমি বৃথাই আমার হাত দিয়ে আমার মুখটা বাচাতে চেষ্টা করলাম।
দুলি খালা শেষ পর্যন্ত যদি আমাকে সরিয়ে না নিতেন তাহলে আম্মু মনে হয় সত্যিই শেষ পর্যন্ত আমাকে মেরে ফেলতেন। আমি প্রথমে কিছুক্ষণ চিৎকার করেছি, কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই আমি আর চিৎকার করতে পারছিলাম না। আমি মেঝেতে পড়ে গেলাম, গলা দিয়ে গোঙ্গানোর মতো এক ধরনের শব্দ বের হতে লাগলো। আপু আর ভাইয়া অনেকবার এই দৃশ্য দেখেছে তারা কাছাকাছি বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে রইল কিন্তু দুলি খালা একসময় আর সহ্য করতে পারল না, আম্মুকে ঠেলে একরকম জোর করে আমাকে সরিয়ে নিল।
পরদিন আমার সারা শরীর ফুলে গেলো। জায়গায় জায়গায় রক্ত নীল হয়ে জমে আছে। তার সাথে গা কাঁপিয়ে জ্বর। আমি আমার ময়লা তোষকের উপর গুটিশুটি মেরে শুয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। জ্বরের ঘোরে আমি বিচিত্র সব জিনিস স্বপ্নে দেখতে লাগলাম, কখনো দেখলাম আম্মু একটা বিশাল কিরিচ নিয়ে আমার দিকে ছুটে আসছেন, আম্মুর চুলে আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে আর আম্মু হা হা করে হাসছেন, তার মুখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে। কখনো দেখলাম পাগলা কুকুর আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়ছে, আঁচড়ে-কামড়ে আমাকে ছিঁড়ে ফেলছে। আবার কখনো দেখলাম একটা বড় ত্রিভুজকে ঘিরে অনেকগুলো ছোট ত্রিভুজ, তাদের ঘিরে আরো অনেকগুলো ছোট ত্রিভুজ। সেগুলো কখনো বড় হচ্ছে কখনো ছোট হচ্ছে কখনো ঘুরছে কখনো নড়ছে, আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি এই ক্ষেত্রটির পরিসীমা বের করতে পারছি না, আর পারছি না বলে যন্ত্রণায় ছটফট করছি।
জ্বরের ঘোর থেকে মাঝে মাঝে আমি জেগে উঠেছি, জেগে উঠে আমি দেখেছি স্টোররুমের অন্ধকার কোনায় আমি শুয়ে আছি। আমার বুকটা খাঁ খাঁ করছিলো একটুখানি স্নেহের কথার জন্যে একটুখানি মমতার কথার জন্যে। শুধু মনে হচ্ছিল, আহা, কেউ যদি আমার কপালে হাত রেখে বলতো, তপু, এখন কেমন লাগছে তোমার? কিন্তু কেউ আমাকে সেটা বলল না, আমি একা একা শুয়ে রইলাম।
কেউ যে আমার কাছে এলো না সেটা সত্যি না। আমি যখন রাত্রিবেলা জ্বরের ঘোরে আধা অচেতন হয়ে পড়েছিলাম তখন হঠাৎ করে আমার হাতের মাঝে একটু সুড়সুড়ি অনুভব করলাম। চোখ খুলে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম নেংটি ইঁদুরটা আমার হাতটা শুকে সেখানে উঠে বসেছে। এক ধরনের কৌতূহল নিয়ে সে আমার দিকে তাকাচ্ছে। প্রতিরাত আমি তার জন্যে রুটির টুকরো এনে রেখেছি, আজ কিছু নেই–নেংটি ইঁদুরটা মনে হয় সেটা বিশ্বাস করতে পারছে না। আমি চোখ খুলে ফিসফিস করে বললাম, মিচকি? তুই এসেছিস?
আমার স্পষ্ট মনে হলো নেংটি ইঁদুরটা মাথা নাড়ল। আমি বললাম, তোর জন্যে কোন খাবার আনতে পারি নি রে মিচকি! সরি। দেখছিস না আমার অবস্থা? আমার আম্মু মেরে আমাকে একেবারে ভর্তা বানিয়ে দিয়েছে।
আমার মনে হলো নেংটি ইঁদুরটা আমার কথা বুঝতে পারল। সেটা সম্মতির ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল। আমি বললাম, আজকে তুই নিজে নিজে কষ্ট করে কিছু একটা খেয়ে নে। কাল তোর জন্যে খাবার আনব। ঠিক আছে?
জ্বরের ঘোরে সবকিছু ওলটপালট হয়ে আছে, তাই আমার মনে হলো নেংটি ইঁদুরটা মাথা নাড়ল। আমি তখন অন্য হাত দিয়ে খুব আস্তে করে তার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিলাম, আর কী আশ্চর্য সেটা অন্যদিনের মতো লাফিয়ে সরে গেলো না। আমি হাতটা নিচে রাখলাম তখন নেংটি ইঁদুরটা হাত থেকে নেমে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে গেল।
আমি স্কুলে গেলাম দুইদিন পর। সারা শরীরে আম্মুর বেল্ট দিয়ে মারের চিহ্ন, সেগুলো আমি শার্ট দিয়ে ঢেকে রেখেছি। শুধু বাম গাল থেকে গলা পর্যন্ত একটা দাগ ঢেকে রাখা যায় নি। সেটা নিয়ে আমি অবশ্যি খুব বেশি ভাবছি না। আমার আম্মু যে আমাকে এভাবে মারেন সেটা কেউ জানে না। সবাই ধরে নেয় আমি পথেঘাটে মারামারি করে নিজের এ অবস্থা করি।
স্কুলে আমাকে দেখে সবাই সরে গিয়ে জায়গা করে দিলো। আমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলো না, শুধু প্রিয়াংকা চোখ কপালে তুলে বললো, সে কী, তোর গালে কী হয়েছে?
আমি বললাম, কিছু না।
আমি বলতে চাইছি না দেখে প্রিয়াংকা আর কিছু জানতে চাইল না। বলল, তুই দুইদিন স্কুলে আসিস নি কেন?
আমি একটু অবাক হয়ে প্রিয়াংকার দিকে তাকালাম, আমি স্কুলে এসেছি কী আসি নাই কেউ সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে পারে সেটা আমার বিশ্বাস হয় না। আমি আমতা আমতা করে বললাম, শরীর খারাপ ছিল।
ও। প্রিয়াংকা হড়বড় করে বলল, তুই যা একটা ফাটাফাটি জিনিস মিস করেছিস!
কী জিনিস?
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কালকে আবার ক্লাসে এসেছিলেন।
সত্যি?
হ্যাঁ।
প্রিয়াংকা রহস্য করে বলল, বল দেখি কী নিয়ে কথা বলেছেন?
মুক্তিযুদ্ধ?
উঁহু। প্রিয়াংকা দাঁত বের করে হেসে বলল, হিন্দু-মুসলমান নিয়ে। এতো সুন্দর করে বলেছেন যে তুই শুনলে বেকুব হয়ে যেতি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
কী বলেছেন?
আমি কী আর ম্যাডামের মতো বলতে পারব? প্রিয়াংকা গম্ভীর হয়ে বলল, বলেছেন যে পৃথিবীটা সুন্দর তার বৈচিত্র্যের জন্যে। তাই যেখানে বৈচিত্র্য বেশি সেখানে সৌন্দর্য বেশি। যেখানে কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান কেউ বৌদ্ধ কেউ খ্রিস্টান এবং বাঙালি কেউ পাহাড়ি কেউ চাকমা কেউ সাঁওতাল এবং সবাই যখন মিলেমিশে থাকে আর একজন আরেকজনের বৈচিত্রটাকে উপভোগ করে সেটাই সবচেয়ে সুন্দর।