বাংলা স্যারও কেমন যেন অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমরা যেরকম জানি না এই স্যারও জানেন না–তাই খানিকক্ষণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থেকে আমতা আমতা করে বললেন, “তু-তু-তুমি অন্ধ?”
মেয়েটা বলল, “আমি চোখে দেখতে পাই না।” কথা শুনে মনে হল অন্ধ আর চোখে দেখতে না পাওয়া দুটি পুরোপুরি ভিন্ন জিনিস। উচ্চারণটা খুব সুন্দর মনে হয় কেউ টেলিভিশনে খবর পড়ছে।
বাংলা স্যার বললেন, “তুমি যদি চোখে না দেখো তা হলে পড়ালেখা করবে কেমন করে?”
“ব্রেইল বই পাওয়া যায়।”
“কী বই?”
“ব্রেইল। হাত দিয়ে ছুঁয়ে পড়তে হয়।”
“পরীক্ষা? পরীক্ষা দিবে কেমন করে?”
“আমি বলব আর একজন লিখে দেবে।”
স্যারের মুখে বিদঘুটে একটা হাসি ফুটে উঠল, “খ্যাঁক” ধরনের একটা শব্দ করে বললেন, “ধুর। এইভাবে লেখাপড়া হয় না কি! আর তোমার লেখাপড়া করে কী লাভ? তুমি কী ডাক্তার হবে না ইঞ্জিনিয়ার হবে? ভালো মানুষেই চাকরি পায় না কানা ল্যাংড়া লুলা মানুষকে কে চাকরি দিবে?”
আমি তখন বুঝতে পারলাম কেন নতুন ম্যাডাম গ্রহণ করার কথা বলেছিলেন। বাংলা স্যার যেটা করছেন সেটা যেন না হয় সেইটাই আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। যেটা করার কথা না বাংলা স্যার ঠিক সেইটাই করছেন। তাকে কেমন করে থামানো যায় বুঝতে পারলাম না। স্যার মনে হল আরো নিষ্ঠুর হয়ে গেলেন, হাত-পা নাড়িয়ে বললেন, “চোখ হাত-পা ঠ্যাং আছে এরকম ছেলেমেয়েদের পড়াতেই আমার জান তামা হয়ে যায় এখন যদি চোখ হাত-পা ঠ্যাং নাই কানা ল্যাংড়া আঁতুড়কে পড়াতে হয় তা হলে আমি কেমন করে পড়াব? আমার কি এতো সময় আছে?”
আমরা সবাই দেখলাম নতুন মেয়েটার দুই গাল লজ্জায় অপমানে লাল হয়ে উঠল। আমাদেরও মনে হল লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাই। স্যার দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন, “বোবা কালা অন্ধদের স্পেশাল স্কুল আছে না?”
মেয়েটা মাথা নাড়ল, “আছে।”
“তুমি সেই স্কুলে পড় না কেন?”
“আমি সেইরকম স্কুলেই পড়তাম। কিন্তু—”
”কিন্তু কী?”
“এখন সারা পৃথিবীতেই সব রকম প্রতিবন্ধীদের সাধারণ স্কুলে পড়ানোর চেষ্টা করা হয়। সেই জন্যে–”
বাংলা স্যার কেমন যেন খেপে উঠলেন, বললেন, “সেই জন্যে এইটা আমাদের স্কুলে শুরু করতে হবে? যতরকম পাগলামি-ছাগলামি সব এই স্কুলে? সব ঝামেলা আমাদের উপর? আমাদের আর খেয়েদেয়ে কাজ নাই?” স্যার একটা নিশ্বাস নিয়ে বললেন, “আমি যখন ক্লাসে পড়াব তুমি সেটা কেমন করে ফলো করবে?”
“আমি সেটা শুনতে পাই। তা ছাড়া আমি রেকর্ড করি–”
“কী কর?”
“আমার একটা ক্যাসেট প্লেয়ার আছে, আমি সেটাতে সবকিছু রেকর্ড করি।”
বাংলা স্যার এবারে কেন জানি একটু থতমত খেয়ে গেলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “বেকর্ড কর?”
“হ্যাঁ।”
“আমি যখন ক্লাস নেওয়া শুরু করব তখন তুমি রেকর্ড করা শুরু করবে?”
“আমি ক্লাসে আসার পরই রেকর্ড করা শুরু করেছি।”
বাংলা স্যার এবারে কেমন যেন নার্ভাস হয়ে গেলেন। আমতা আমতা করে বললেন, “ইয়ে মানে আমি এতক্ষণ যা যা বলেছি সব রেকর্ড হয়ে গেছে?”
“জি স্যার।” মেয়েটা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, তারপর বলল, “আসলে স্যার আমি এই স্কুলে আসতে চাইনি। আমি আমাদের স্কুলেই খুব ভালো ছিলাম। কিন্তু ডক্টর রাইসা জোর করলেন তাই এসেছি। রাইসা ম্যাডাম বলেছেন ছয় মাস দেখতে। যদি ছয় মাসে ঠিকভাবে কাজ না করে তা হলে আমার স্কুলে ফিরে যাব।“
মেয়েটা তার ব্যাগ থেকে ভাঁজ করা ছোট লাঠিটা বের করল, ছেড়ে দিতেই সেটা লম্বা হয়ে গেল। লাঠিটা মেঝেতে ছুঁইয়ে সে বলল, “স্যার আসলে ছয় মাস লাগবে না, আমি কিছুক্ষণেই বুঝে গেছি এটা কাজ করবে না। আপনি যদি অনুমতি দেন তা হলে আমি যাই।”
বাংলা স্যার আমতা আমতা করে বললেন, “আর ইয়ে-মানে রেকর্ডিং-”
“সেটা শুনলে কেউ আর আমাকে জোর করবে না।”
মেয়েটা তার ব্যাগটা নিয়ে দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “আমার আব্বু নিশ্চয়ই এখনো চলে যান নাই।” মেয়েটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে ঘুরে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি সরি যে আমার জন্যে তোমাদের এতো সময় নষ্ট হল। প্লীজ তোমরা কিছু মনে কোরো না।”
মেয়েটা যখন ঠিক দরজার কাছে গিয়েছে তখন আমার কী হল কে জানে আমি তড়াক করে লাফ দিয়ে বললাম, “দাঁড়াও।”
আর কী আশ্চর্য, পুরো, ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে একসাথে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, “দাঁড়াও। দাঁড়াও!”
রিতু, শান্তা আর মামুন মেয়েটার দিকে ছুটে গেল। রিতু খপ করে মেয়েটার হাত ধরে বলল, “না তুমি যেতে পারবে না। তুমি আমাদের সাথে পড়বে।”
শান্তাও তাকে ধরে ফেলল, বলল, “হ্যাঁ পড়বে। আমাদের সাথে পড়বে। তোমাকে আমরা যেতে দেব না।”
ক্লাসের ছেলেমেয়েরা হুড়মুড় করে ছুটে যেতে থাকে, চারিদিক দিয়ে মেয়েটাকে ঘিরে ফেলল, সবাই চিৎকার চেঁচামেচি করে বলতে লাগল, “যেতে দেব না। যেতে দেব না। আমাদের সাথে পড়তে হবে। পড়তে হবে।”
আমি খুব কাছে থেকে মেয়েটার দিকে তাকিয়েছিলাম, মেয়েটার চোখ দুটো কী সুন্দর, একেবারে ঝকঝক করছে, কিন্তু সে এই চোখ দুটো দিয়ে তাকাতে পারে কিন্তু দেখতে পারে না। আমি দেখলাম তার চোখ দুটোতে পানি টলটল করছে, সে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ দুটো মুছে ফিসফিস করে বলল, “থ্যাংকু। তোমাদের অনেক থ্যাংকু।”