সুজন বলল, “বজলু বলেছে আপনি না কি চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ। ভিজিট তিনশ টাকা। আসলে–”
নতুন ম্যাডাম চোখ বড় বড় করে বলল, “আসলে?”
“আসলে আপনি নাক-কান-গলার ডাক্তার। আমি এবিসি টাওয়ারে আপনার নাম দেখেছি।”
বজলু গরগর করতে করতে বলল, “দেখে নাই।”
আমরা সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে এই নাটকটা দেখছিলাম। আবিষ্কার করলাম ম্যাডাম হঠাৎ হাসতে শুরু করেছেন। হাসতে হাসতে বললেন, “এই ব্যাপার?”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কে ঠিক ম্যাডাম?”
ম্যাডাম আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে দুইজনের হাত ধরে কাছে টেনে এনে বললেন, “এর পরের বার আমাকে নিয়ে মারামারি করার আগে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে যেও। বুঝেছ?”
দুইজনেই পিটপিট করে ম্যাডামের দিকে তাকাল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন ম্যাডাম?”
ম্যাডাম আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তার কারণ আমি ডাক্তার না। আমার কোনো চেম্বার নাই। আমি চিকিৎসা করি না। আমি ভিজিট নেই না।”
সুজন মাথা চুলকে বলল, “আপনি ডাক্তার না?”
“না।”
“কিন্তু অফিসে লেখা আছে ডক্টর রাইসা–”
“সেটা লেখা আছে তার কারণ আমি একটা পি-এইচডি করেছি। কেউ পি-এইচডি করলে তাকে ডক্টর বলে।”
রিতু মাথা নেড়ে বলল, “ও বুঝেছি! বিএ এমএ যেরকম সেরকম পি-এইচডি।”
“হ্যাঁ।” ম্যাডাম মাথা নাড়লেন, “সেরকম।”
“ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যেরকম ডক্টর সেরকম ডক্টর–”
ম্যাডাম হেসে ফেললেন, বললেন, “হ্যাঁ। তবে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অনেক বড় মানুষ। জ্ঞানী মানুষ–তার সাথে আমার তুলনা কর না, সেটা ঠিক হবে না।”
রিতু আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ম্যাডাম তার আগেই সুজন আর বজলুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এখন তোমরা দুইজন বল তোমাদের কী বলার আছে?”
কারো কিছু বলার নেই। দুইজনেই বোকার মতোন একটু হাসার চেষ্টা করল। ম্যাডাম বললেন, “একজন আরেকজনের সাথে হ্যান্ডশেক করে বল, আমি দুঃখিত। আমি আর কোনোদিন মারামারি করব না। বল।”
দুজনেই একটু গাঁইগুই করে শেষে একজন আরেকজনের হাত ধরে বলল, “আমি দুঃখিত। আমি আর মারামারি করব না।”
.
কয়েকদিনের মাঝেই আমাদের নতুন ম্যাডাম অনেক বিচিত্র বিচিত্র কাজ করে ফেললেন। কিন্তু সবচেয়ে বিচিত্র কাজটার কথা আমরা জানলাম মাসখানেক পরে।
০৩-৪. সম্পূর্ণ অন্যরকম একজন
যখন আমাদের ক্লাসে ভর্তি হল সম্পূর্ণ অন্যরকম একজন যার কারণে আমাদের পুরো ক্লাসটাই হয়ে গেল একটু অন্যরকম
আমরা ক্লাসে বসে আছি, বাংলা স্যার রোল কল শেষ করে বইটা হাতে নিয়েছেন তখন আমরা দেখতে পেলাম করিডোর ধরে নতুন ম্যাডাম হেঁটে আসছেন। তার পিছনে একজন মানুষ আর মানুষটার পিছনে একটা মেয়ে। মেয়েটা নিশ্চয়ই একটু
নেকু টাইপের, এতো বড় হয়েছে কিন্তু এখনো তার আব্বুর হাত ধরে হাঁটছে।
নতুন ম্যাডাম আমাদের ক্লাসের দরজার পাশে দাঁড়ালেন, বললেন, “আমরা ভেতরে আসতে পারি?”
বাংলা স্যার মাথা ঘুরিয়ে নতুন ম্যাডাম, তার সাথে বাবা আর মেয়েকে দেখে ব্যস্ত হয়ে বললেন, “আসেন। আসেন।”
নতুন ম্যাডাম, বাবা আর সেই মেয়েটি ক্লাসে এসে ঢুকল। মেয়েটা এখনো তার বাবার হাত ধরে রেখেছে। খুব সুন্দর কাপড় পরে আছে, দেখে মনে হল একটু অহংকারী। কেউ নতুন জায়গায় এলে চারিদিকে তাকায়, সবাইকে লক্ষ করে–এই মেয়েটা সেরকম কিছুই করল না, কেমন জানি সোজা সামনে তাকিয়ে রইল।
নতুন ম্যাডাম আমাদের সবাইকে মাথা ঘুরিয়ে একবার দেখলেন, তারপর বললেন, “তোমাদের ক্লাসে একজন নতুন ছাত্রী ভর্তি হয়েছে। আমি তাকে নিজে নিয়ে এসেছি। সাথে তার বাবাও আছেন।”
।বাবা তখন একটু হাত নেড়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলেন। ম্যাডাম বললেন, “ছাত্রীটির নাম মাইশা হাসান। ডাকনাম আঁখি। আঁখি তোমাদের দশজনের থেকে একটু অন্যরকম। আমি ইচ্ছে করলে আগে থেকে তোমাদের সেটা জানাতে পারতাম-ইচ্ছে করে জানাইনি। তোমাদের ক্লাসে তোমরা আঁখিকে ঠিকভাবে গ্রহণ কর।”
আমরা ম্যাডামের কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারলাম না। তাকে দেখে মোটও অন্যরকম মনে হচ্ছে না-বাড়তি হাত-পা নেই একেবারে স্বাভাবিক। ক্লাসে ভর্তি হয়েছে সে আর দশজনের মতো ক্লাস করবে–তাকে আবার গ্রহণ করব কেমন করে? তার গলায় কি ফুলের মালা দিতে হবে? না কি তার জন্যে গান গাইতে হবে?
নতুন ম্যাডাম মেয়েটার বাবাকে নিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলেন। বাংলা স্যার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলেন, মেয়েটাও ক্লাস রুমের দিকে তাকিয়ে রইল। স্যার গলা খাকারি দিয়ে বললেন, “যাও। বস।”
মেয়েটা বলল, “কোথায়?”
শান্তা একটু সরে তার পাশে জায়গা করে দিয়ে বলল, “এইখানে।”
মেয়েটা তার ব্যাগটা খুলে সাদা মতো কী একটা বের করল, সেটা ছেড়ে দিতেই খুলে একটা সাদা লাঠি হয়ে গেল। মেয়েটা সেই লাঠিটা মেঝেতে লাগিয়ে ডানে-বামে একটু নাড়িয়ে সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে শান্তার বেঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল এবং তখন হঠাৎ করে আমরা সবাই বুঝতে পারলাম এই মেয়েটা চোখে দেখতে পায় না। নিজের অজান্তেই আমরা সবাই একটা চাপা শব্দ করলাম। করলাম এই
মেয়েটা খুব শান্ত ভঙ্গিতে এসে শান্তার পাশে বসে পড়ল, তারপর হাতের সাদা লাঠিটা ভাজ করে তার ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোনো কিছু দেখছে না কিন্তু তাকিয়ে আছে, কী আশ্চর্য!