আরেকজন আরো জোরে মাথা নেড়ে বলল, “বইয়ের পৃষ্ঠা কেটে নেবে।”
“পৃষ্ঠা কাটা কী বলছেন?” আমাদের বিজ্ঞান স্যার বললেন, “পুরো বই নিয়ে চলে যাবে। দুই দিনে লাইব্রেরি ফাঁকা হয়ে যাবে।”
ইংরেজির ম্যাডাম ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ইস! কী সুন্দর বইগুলো আলমারির মাঝে সাজানো ছিল–সবগুলো ওলটপালট করে দিল!”
নতুন ম্যাডাম ইংরেজি ম্যাডামের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তারপর হাসতে শুরু করলেন, তার হাসি থামতেই চায় না। ইংরেজি ম্যাডাম তো হাসির কোনো কথা বলেননি-ঠিকই বলেছেন নতুন ম্যাডাম এর মাঝে এতো হাসির কী পেয়েছেন কে জানে! আমি অবশ্যি সেটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না, আমি ভূতের বইটার মাঝে ঝুঁকে পড়লাম, পোড়ো বাড়িতে দুইজন রাত কাটাতে এসেছে, পুরোনো সিন্দুক থেকে মাথা কাটা একটা মানুষ বের হয়ে এসেছে সেই নিয়ে ফাটাফাটি গল্প।
কীভাবে কীভাবে যে টিফিনের সময়টা কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। ঘণ্টা পড়া মাত্র আমি বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালাম। নতুন ম্যাডাম বলেছেন যেখান থেকে আমরা যে বইটা নামিয়েছি সেখানে বইটা তুলে রাখতে হবে কিন্তু তা হলে আমার বইটা আরেকজন নিয়ে নিবে। তাই আমি উঁইয়ে খাওয়া রাজনীতির কিছু বইয়ের পিছনে ভূতের বইটা লুকিয়ে রাখলাম যেন আর কেউ খুঁজে না পায়। ম্যাডাম বলেছেন আমরা ছোটখাটো দুষ্টুমি করতে পারব–এটা তার ভিতরেই পড়ে–এটা মোটেও বড় ধরনের দুষ্টুমি না। আমি যদি প্যান্টের ভিতরে খুঁজে লুকিয়ে বাইরে নিয়ে যেতাম সেটা হত বড় ধরনের দুষ্টুমি।
.
নতুন ম্যাডাম আসার কারণে আমাদের স্কুলে অনেক ধরনের পরিবর্তন হতে লাগল–কিছু ভালো কিছু খারাপ। আমরা এখন লাইব্রেরিতে বই পড়তে পারি সেটা ভালো, মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে খেলতে পারি সেটা ভালো। আগে বইয়ের কয়েকটা প্রশ্ন মুখস্থ করলেই হত এখন পুরো বইটা পড়তে হয় সেটা খারাপ। আগে একজনের হোমওয়ার্ক দেখে আরেকজন নকল করে ফেলতে পারতাম এখন সবার আলাদা আলাদা করে করতে হয় সেটাও খারাপ। নতুন ম্যাডাম সম্পর্কেও আমরা নতুন নতুন জিনিস জানতে লাগলাম। আগে একজন স্যার-ম্যাডামকে দেখলে আমরা চেষ্টা করতাম দূরে দূরে থাকতে–নতুন ম্যাডাম আসার পর সেটাও পাল্টে গেছে–আমরা নিজে থেকে গিয়ে তার সাথে কথা বলি। আমাদের কথা বলার বেশি কিছু থাকে না কিন্তু মেয়েদের কথা শেষ হয় না। যেমন তারা ম্যাডামকে দেখলে বলে, “ম্যাডাম আপনার শাড়িটা কী সুন্দর!”
আমরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেও বুঝি না শাড়ির কোন জায়গাটা সুন্দর। শাড়ি তো শাড়িই–সেটা আবার সুন্দর হয় কেমন করে? নতুন ম্যাডাম অবশ্যি মেয়েদের কথাকে গুরুত্ব দেন, হাসি হাসি মুখে বলেন, “থ্যাংকু!”
আবার কোনো কোনো মেয়ে বলে, “ম্যাডাম আপনার টিপটা কী সুন্দর!”
কপালে ছোট একটা টিপ আছে কী নেই সেইটাই আমাদের চোখে পড়ে না–মেয়েদের ঠিকই চোখে পড়ে। সেইটা না কি আবার সুন্দর! সবচেয়ে সাহস বেশি আমাদের শান্তার, সে একদিন নতুন ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে বলল, “ম্যাডাম-ম্যাডাম আপনার টিপটা মাঝখানে হয় নাই।”
কী আশ্চর্য–ম্যাডাম দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন, “তাই না কি?”
“জি ম্যাডাম। আরেকটু ডান দিকে যাবে।”
নতুন ম্যাডাম টিপটা খুলে নতুন করে লাগালেন, শান্তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এখন ঠিক আছে?”
শান্তা মাথা নাড়ল, “না ম্যাডাম বেশি ডান দিকে হয়ে গেছে।”
নতুন ম্যাডাম আবার খুলে বাম দিকে সরালেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “এখন?”
“উঁহু। বেশি বাম দিকে হয়ে গেছে!”
আমি নতুন ম্যাডাম হলে টিপ ছুঁড়ে দিয়ে শান্তার ঘাড় ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলতাম, ভাগো এখান থেকে। কিন্তু নতুন ম্যাডামের ধৈর্যের শেষ নাই, মাথাটা নিচু করে শান্তার কাছে এগিয়ে নিয়ে বলেন, “নাও। তুমি ঠিক করে লাগিয়ে দাও!”
শান্তা তখন তার সবগুলো দাঁত বের করে হাসতে হাসতে ম্যাডামের কপালে টিপ ঠিক করে দেয়! এরকম কাণ্ড মনে হয় কেউ জীবনেও দেখেনি।
তবে নতুন ম্যাডামকে নিয়ে আমাদের যে কোনো সমস্যা হয় নাই সেটাও ঠিক না। প্রথম দিন আমরা শুনেছি নতুন ম্যাডাম হচ্ছেন ডক্টর রাইসা খালেদ। যার অর্থ ম্যাডাম হচ্ছেন ডাক্তার আমাদের বজলু খবর আনল যে নতুন ম্যাডাম স্টেডিয়াম মার্কেটে রোগী দেখেন, তিনশ টাকা ভিজিট। ম্যাডাম হচ্ছেন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ। সুজন খবর আনল অন্যরকম, সে বলল ম্যাডামের চেম্বার এবিসি টাওয়ারে ভিজিট চারশ টাকা, স্কুলের ছেলেমেয়েদের ফ্রি দেখে দেন। সবচেয়ে বড় কথা ম্যাডাম মোটেও চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ না, ম্যাডাম হচ্ছে নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ। এই নিয়ে বজলু আর সুজন প্রথমে তর্ক করল, তারপর ঝগড়া করল শেষে মারামারি করল। সুজন মোটামুটি গুণ্ডা টাইপের সে বজলুকে আচ্ছামতোন পিটিয়ে দিল-মারামারির মাঝামাঝি শান্তা দৌড়ে গিয়ে নতুন ম্যাডামকে খবর দিল-নতুন ম্যাডামও দৌড়ে এসে দুজনকে থামালেন। তারপর কোমরে হাত দিয়ে বললেন, “কী ব্যাপার? স্কুলের ভেতর মারামারি? তোমাদের হয়েছেটা কী?”
সুজন বলল, “বজলু আপনাকে নিয়ে মিথ্যা কথা বলছে।”
বজলু গর্জন করে বলল, “আমি মিথ্যা কথা বলি নাই–তুই বলেছিস।”
সুজন আরো জোরে গর্জন করে বলল, “তুই বলেছিস।”
ম্যাডামের সামনেই আবার ঝগড়া লেগে যায় এরকম অবস্থা। ম্যাডাম দুইজনকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী মিথ্যা কথা বলেছে?”