আমরা সবাই নিশ্বাস বন্ধ করে বসে রইলাম, বাংলা স্যারকে কেউ এরকম একটা প্রশ্ন করতে পারে সেটা নিজের কানে শুনেও আমাদের কারো বিশ্বাস হল না। স্যার চোখ লাল করে সুজনের দিকে তাকালেন। মানুষের চোখ দিয়ে আগুন বের হবার ব্যবস্থা থাকলে সুজন এতক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে যেত। সুজন পুড়ে ছাই হয়ে গেল না আর আমরা সবাই বুঝতে পারলাম ভয়ংকর বাংলা স্যার এতদিন ছিলেন একটা বাঘের মতো–এখন সেই বাঘের সব দাঁত আর নখ তুলে ফেলা হয়েছে, এখন স্যার আর বাঘ নেই, বড় সাইজের বিড়াল হয়ে গেছেন। স্যারকে আর ভয় পেতে হবে না। তাই আমিও সাহস পেয়ে গেলাম, বললাম, “স্যার, আপনি বলেছিলেন আমাদের লাইব্রেরিতে যেতে দেওয়া হবে না। কিন্তু নতুন ম্যাডাম বলেছেন লাইব্রেরিটা খুলে দেবেন।”
এটা কোনো প্রশ্ন না, স্যারের উত্তর দেবার কিছু নেই তাই স্যার উত্তর না দিয়ে চোখ লাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, আগে হলে এই চোখের দৃষ্টি দেখে আমার হাত-পা শরীরের ভিতরে ঢুকে যেত-আজকে কিছুই হল না। আমি উল্টো জিজ্ঞেস করলাম, “আমরা কখন লাইব্রেরিতে যাব স্যার? আমাদের কি আলাদা লাইব্রেরি ক্লাস হবে?”
স্যার আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না, নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে রেজিস্টার খাতাটা রোল করার জন্যে খুললেন। তখন মামুন বলল, “স্যার! ম্যাডাম বলেছেন কোনো স্যার যদি আমাদেরকে মারেন তা হলে তার জেল হয়ে যাবে। কয় বছরের জেল হবে স্যার?”
এটা মোটেও হাসির কথা নয় কিন্তু কয়েকজন নিচু গলায় খুক খুক করে হেসে উঠল। স্যার ভান করলেন যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না। মামুন একটু গাধা টাইপের, সে একটা কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে। এবারেও তাই শুরু করল, আবার জিজ্ঞেস করল, “কয় বছর স্যার?”
স্যার কোনো উত্তর দেবার চেষ্টা করলেন না তাই ক্লাসের ছেলেমেয়েরা নিজেরাই উত্তর দেওয়া শুরু করল, রিতু বলল, “এটা নির্ভর করে কতটুকু মেরেছেন তার উপর। মনে কর কান ধরে টানলে এক বছর, চড় মারলে দুই বছর, বেত দিয়ে মারলে তিন বছর। তাই না স্যার?”
মাসুম বলল, “আর চড় দিয়ে কানের পর্দা ফাটিয়ে দিলে?”
সারা ক্লাস চুপ করে গেল, আমরা সবাই জানি কবিতা মুখস্থ বলতে পারেনি দেখে এই বাংলা স্যার চড় মেরে মাসুমের কানের পর্দা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। কয়েক সেকেন্ড কেউ কোনো কথা বলল না, তখন সুজন বলল, “মনে হয় ফাঁসি হয়ে যাবে।”
বাংলা স্যারকে ফাঁসির আসামির মতো দেখাতে লাগল, আর ঠিক ফাঁসির আসামির মতোই বাংলা স্যার কাঁপা গলায় রোল কল নেওয়া শুরু করলেন।
.
প্রত্যেক দিনই আমরা ক্লাস নেবার সময় অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করি কখন টিফিন ছুটি হবে–আজকে আরো বেশি অধৈর্য হয়ে গেলাম। যখন শেষ পর্যন্ত টিফিন ছুটির ঘণ্টা পড়ল তখন আমরা রীতিমতো ছুটতে ছুটতে লাইব্রেরির সামনে হাজির হয়েছি, নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হয় না, লাইব্রেরির দরজাটা খোলা। আমরা হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকে গেলাম। লাইব্রেরি ঘরের মাঝখানে বড় বড় টেবিল, সেই টেবিলের দুই পাশে চেয়ার। দেয়াল ঘেঁষে সারি সারি আলমারি, আলমারি বোঝাই বই। লাইব্রেরির এক কোনায় আমাদের নতুন ম্যাডাম দাঁড়িয়ে একজনের সাথে কথা বলছিলেন, আমাদের ঢুকতে দেখে মাথা ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। আমরা সবসময় দেখেছি স্যার আর ম্যাডামরা আমাদের দেখলেই তাদের ভুরু কুঁচকে ফেলেন, তাদের মুখ কঠিন হয়ে যায়, মুখ খিঁচিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “কী চাই?” নতুন ম্যাডামের সেরকম কিছু হল না। উল্টো তার মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে উঠল, হাসি হাসি মুখে বললেন, “কী খবর তোমাদের?”
আমি বললাম, “ম্যাডাম, আমরা লাইব্রেরি দেখতে এসেছি।”
ম্যাডাম বললেন, “ভেরি গুড! এসো, দেখো।”
রিতু বলল, “ম্যাডাম আমরা বই পড়তে পারব!”
ম্যাডাম হাসলেন, বললেন, “অবশ্যই পারবে। লাইব্রেরিতে যদি বই পড়তে পার তা হলে কোথায় বই পড়বে?”
মামুন জিজ্ঞেস করল, “ম্যাডাম, আমরা বাসায় বই নিতে পারব?”
“পারবে। সেই জন্যে অবশ্যি একটা সিস্টেম দাঁড় করাতে হবে। এখনো কোনো সিস্টেম নেই–তাই দুই-একদিন সময় দিতে হবে। এখন এখানে বসে বসে পড়।”
“যেটা ইচ্ছা পড়ব?”
“হ্যাঁ। যেটা ইচ্ছা।”
“আলমারি খুলে বই বের করব? যেটা ইচ্ছা?”
ম্যাডাম হাসলেন, বললেন, “যেটা ইচ্ছা।”
ম্যাডামের কথা শেষ হবার আগেই সবাই চিৎকার করে আলমারিগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, টেনে টেনে বই নামাতে লাগল, কাড়াকাড়ি করে বইগুলো দেখতে লাগল। আমি ভয়ংকর একটা ভূতের বই পেয়ে গেলাম, প্রচ্ছদে মানুষের কাটা একটা মাথা, সেটা পচে ফুলে আছে, চোখের ভেতর থেকে একটা কিলবিলে পোকা বের হয়ে আসছে, বইটা দেখে আমার জিবে একেবারে পানি এসে গেল। আমি তখন তখনই একটা চেয়ার টেনে বইটা নিয়ে বসে গেলাম।
ম্যাডাম ঘুরে ঘুরে দেখলেন, তারপর বললেন, “আমাদের লাইব্রেরির জন্যে এখন কোনো স্টাফ নেই, তাই নিজেদের একটু কাজ করতে হবে। বই পড়া শেষ হলে যেখান থেকে যেটা নামিয়েছ সেটা সেখানে তুলে রেখো।”
“রাখব ম্যাডাম।”
লাইব্রেরি দেখতে আরো কয়েকজন স্যার-ম্যাডাম এসেছেন। তাদের একজন হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “রাখবে না। কেউ ঠিক জায়গায় রাখবে না।”