আমরা সবাই জোরে জোরে মাথা নাড়লাম। ম্যাডাম বললেন, “তার মানে হচ্ছে আমাদের কোনো শিক্ষক যদি তোমাদের গায়ে হাত তোলে, তোমাদের বেত মারে আর তোমরা যদি কমপ্লেইন কর তা হলে শিক্ষকদের হাতে হাতকড়া লাগিয়ে থানায় নিয়ে যাবে–”
ছোট ক্লাস থেকে রিনরিনে গলায় একটা ছোট মেয়ে জিজ্ঞেস করল, “কান ধরে টানলে?”
“কান ধরে টানাও শারীরিক শাস্তি। এটা করাও বাংলাদেশের আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কাজেই আমাদের শিক্ষকদের এখন খুবই সতর্ক থাকতে হবে-আমরা ভুলেও যেন কোনো ছেলেমেয়ের গায়ে হাত না তুলি। আমি এই স্কুলে এসে এই বেতগুলো পেয়েছি–এটা খুবই বিপজ্জনক। বাইরে যদি খবর যায় তা হলে আমাদের শিক্ষকরা খুব বড় বিপদে পড়ে যেতে পারেন। আমি নিশ্চিত তারা কখনোই বেতগুলো দিয়ে তোমাদের মারেননি, শুধুমাত্র ভয় দেখানোর জন্যে এগুলো রেখেছেন—”
তখন অ্যাসেম্বলির সব ছেলেমেয়ে একসাথে চিৎকার করে উঠল, বলল–”মেরেছেন! মেরেছেন।”
ম্যাডাম কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তার মুখটা দেখতে দেখতে কঠিন হয়ে গেল, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে থমথমে গলায় বললেন, “যদি মেরে থাকেন তা হলে খুব বড় অন্যায় করেছেন। যাই হোক যেটা হয়ে গেছে আমি সেটাকে আর ফিরাতে পারব না। কিন্তু আমি তোমাদের কথা দিচ্ছি এই স্কুলে আমার কোনো ছেলেমেয়ের গায়ে আর কেউ কোনোদিন হাত তুলতে পারবে না!”
আমরা সবাই তখন আনন্দে চিৎকার করতে লাগলাম। দুষ্টুমি করার জন্যে যারা সবচেয়ে বেশি পিটুনি খেয়েছে তারা আনন্দে রীতিমতো লাফাতে লাগল। আর যে স্যারেরা বেত দিয়ে আমাদের সকাল-বিকাল পিটিয়েছেন তাদের মুখ দেখে মনে হতে লাগল কেউ তাদের জোর করে আলকাতরা খাইয়ে দিয়েছে।
আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু ছেলে হচ্ছে সুজন, সে হাত তুলে জিজ্ঞেস করল, “ম্যাডাম। এই বেতগুলো এখন কী করবেন?”
ম্যাডাম বললেন, “পুড়িয়ে ফেলব।”
অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে থাকা সব ছেলেমেয়ে আনন্দে আবার চিৎকার করে উঠল। বেতগুলো পোড়ানো হবে সেটা আমরা শুনেছি কিন্তু কেউই বুঝতে পারিনি সেগুলো এখনই আমাদের সামনে পোড়ানো হবে। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম ম্যাডাম মানিককে ডাকলেন, সে নিচে কয়েকটা ইট বিছিয়ে তার উপর বেতগুলো রাখল। তারপর একটা প্লাস্টিকের বোতল থেকে বেতগুলোর উপর কী যেন ঢালল, মনে হয় কেরোসিন না হয় পেট্রল। তারপর একটা ম্যাচ দিয়ে সেটাতে আগুন ধরিয়ে দিল। দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে আর আমরা আনন্দে চিৎকার করতে থাকি। ম্যাডাম হাত তুলে আমাদের থামালেন, তারপর বললেন, “এখন তোমরা আমাকে কথা দাও তোমরা কখনো এমন কিছু করবে না যার জন্যে তোমাদের স্যার আর ম্যাডামরা তোমাদের উপর রেগে ওঠেন–আর তারা তোমাদের গায়ে হাত তোলার চেষ্টা করেন। কথা দাও।”
আমরা চিৎকার করে বললাম, “কথা দিলাম।”
“কথা দাও তোমরা মন দিয়ে লেখাপড়া করবে।”
আমরা বললাম, “মন দিয়ে লেখাপড়া করব।”
“একটু আধটু দুষ্টুমি করলে ক্ষতি নেই, কিন্তু কেউ বড় দুষ্টুমি করবে না। কথা দাও সবাই স্কুলের নিয়ম মেনে চলবে।”
একটু আধটু দুষ্টুমি করতে পারব শুনে আমরা সবাই খুশি হয়ে উঠলাম তাই আনন্দে চিৎকার করে বললাম, “স্কুলের নিয়ম মেনে চলব।”
ম্যাডাম খুব খুশি হয়ে উঠলেন, তারপর বললেন, “মনে থাকে যেন, তোমরা কিন্তু আমাদের কথা দিয়েছ। কথা দিলে কিন্তু কথা রাখতে হয়। তোমরা সবাই কথা রাখবে তো?”
আমরা সবাই চিৎকার করে বললাম, “রাখব ম্যাডাম, রাখব।”
ছোটখাটো দুষ্টুমি করা এমন কিছু কঠিন না, এই কথাটা তো রাখাই যায়। ম্যাডাম তখন তার হাতঘড়ি দেখলেন তারপরে বললেন, “তোমাদের ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে–এখন সবাই ক্লাসে যাও।” তখন হঠাৎ তার কী যেন একটা মনে পড়ল, আবার হাত তুলে বললেন, “আর শোনো-আমি তোমাদের স্কুল লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম! এটা কতোদিন খোলা হয়নি কে জানে–পুরো লাইব্রেরিতে আধ ইঞ্চি উঁচু ধুলো জমেছে। অনেক বই উঁই কেটে ফেলেছে! তবে সুখের কথা হল যেসব বইগুলো উইয়ে কেটেছে তার বেশিরভাগ হচ্ছে রাজনৈতিক বই! সরকারি টাকা নষ্ট করে এই বইগুলো কেনা হয়েছিল। ভালো বইগুলো কাটেনি!”
আমরা আবার আনন্দে চিৎকার করলাম। সব স্যার-ম্যাডামের সামনে দাঁড়িয়ে। অ্যাসেম্বলিতে যে এভাবে চিৎকার করা যায় সেটা আমরা কোনোদিন কল্পনাও করিনি। আর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে যে এতো আনন্দ সেটাও আমরা আগে বুঝতে পারিনি।
আমাদের চিৎকার কমে আসা পর্যন্ত ম্যাডাম অপেক্ষা করলেন তারপর বললেন, “আমি তোমাদের জন্যে লাইব্রেরি খুলে দেব। তোমরা পড়ার জন্যে বই নিতে পারবে, বই পড়তে পারবে। আমাকে একটু সময় দাও, আমি নতুন নতুন মজার মজার বই দিয়ে লাইব্রেরিটা বোঝাই করে দেব!”
ম্যাডামের কথা শেষ হওয়ার আগেই আমরা আবার গলা ফাটিয়ে আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম।
.
আমাদের প্রথম ক্লাস বাংলা। বাংলা স্যার মুখ কালো করে ক্লাসে ঢুকলেন, তাকে দেখে মনে হতে লাগল কেউ বুঝি জোর করে তার গলা দিয়ে আধা গ্লাস কেরোসিন ঢেলে দিয়েছে। এই স্যার আর কোনোদিন আমাদের মারতে পারবেন না, সেটা এখনো আমাদের কারোরই বিশ্বাস হতে চায় না। আমরা সবাই চোখ বড় বড় করে স্যারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। স্যার টেবিলে চক ডাস্টার আর রেজিস্টার খাতা রেখে আমাদের দিকে তাকালেন। আগে তার সাথে একটা বেত থাকতো–আজকে নেই। ম্যাডাম সেটা পুড়িয়ে ফেলেছেন। আমাদের ভেতরে সবচেয়ে দুষ্টু হচ্ছে সুজন, এই স্যারের হাতে সবচেয়ে বেশি মারও খেয়েছে সুজন। তাই তার আনন্দ হল সবচেয়ে বেশি। সে দাঁত বের করে হেসে স্যারকে জিজ্ঞেস করল, “স্যার, ম্যাডাম যে আপনার বেতটা পুড়িয়ে ফেলেছেন সেই জন্যে আপনার কি একটু মন খারাপ হয়েছে?”