যারা ঢুকেছে তাদের সবার সামনে কাদের বক্স, তার হাতে একটা ক্যামেরা। ভিতরে ঢুকে সে চারিদিকে তাকাল, ভয়ে আমাদের বুক ধুকপুক করতে থাকে। কম্বল দিয়ে যেখানে গর্তটা ঢেকে ফেলা হয়েছে, তার সামনে আঁখি বসে আছে যেন কেউ ওদিকে না যায়।
কাদের বক্স বলল, “সবাই এদিকে আয়।”
আমরা তার কথামতো পাশাপাশি এসে দাঁড়ালাম। তখন সে ক্যামেরা দিয়ে একজন একজন করে আমাদের সবার ছবি তুলল। তারপর জিব দিয়ে সন্তুষ্টির একটা শব্দ করে বলল, “তোদের ছবি নিয়ে নিলাম।”
আমরা কোনো কথা বললাম না। তখন কাদের বক্স বলল, “তোদের বাপ মায়ের কাছে পাঠাব। কী মনে হয়, তোদর বাপ-মা টাকা-পয়সা কিছু দেবে? না
কী তোরা সব বাপে খেদানো মায়ে খেদানো ছেলেমেয়ে? তোদের কী হল সেটা নিয়ে বাপ-মায়ের কোনো মাথাব্যথা নেই?”
এবারেও আমরা কোনো কথা বললাম না। কাদের বক্স তখন একটু গরম হয়ে বলল, “কী হল, কথা বলিস না কেন?”
আঁখি বলল, “উল্টোটাও তো হতে পারে?”
“উল্টোটা? সেটা আবার কী?”
“আমাদের বাবা-মা খুঁজে আপনাদের বের করে ফেলে। পুলিশ মিলিটারি আপনাদের এরেস্ট করে ফেলে।”
কাদের বক্স এরকম একটা উত্তরের জন্যে প্রস্তুত ছিল না, সে থতমত খেয়ে যায়। তারপর হঠাৎ করে রেগে উঠে, “কী বললি তুই? আমি এরেস্ট হব? আমি? কাদের বক্স? শুনে রাখ, পুলিশের বাবার সাধ্যি নাই আমাকে এরেস্ট করে। বুঝেছিস?”
কাদের বক্সের সাথে যে মানুষগুলো এসেছে তাদের একজন বলল, “কতো বড় বেয়াদপ মেয়ে। এক চড় মেরে দাঁতগুলো খুলে ফেলা দরকার। ওস্তাদ দিব না কি একটা চড়?”
কাদের বক্স হাত নেড়ে বলল, “বাদ দে। মজা তো এখনো টের পায় নাই, সেই জন্যে এতো তেজ!”
কাদের বক্স তার লোকজনকে নিয়ে বের হয়ে গেল আর সাথে সাথে আমরা আবার কাজে লেগে গেলাম। দেখতে দেখতে আমাদের হাত লাল হয়ে উঠল। হাতের চামড়া উঠে গেল, ফোঁসকা পড়ে গেল কিন্তু আমরা থামলাম না। আমরা মাটি খুঁড়ে যেতেই লাগলাম। খুঁড়ে যেতেই লাগলাম।
.
মাঝখানে দুপুরে আমাদের খেতে দিল, আগেরবারের মতো রিতুকে আনতে হল না, তাদের একজন নিজেই দিয়ে গেল। খাবারের মেনু খুবই সহজ, শুকনো মোটা রুটি আর বুটের ডাল। আমাদের বাসায় কেউ এরকম একটা খাবার আমাদের জোর করেও খাওয়াতে পারত না। কিন্তু এখানে আমরা গপগপ করে রীতিমতো কাড়াকাড়ি করে খেলাম। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে আমাদের সবারই পরিশ্রম হয়েছে, সবারই পেটে খিদে! সত্যি কথা কী এই মোটা রুটি আর বুটের ডালকে মনে হল অসাধারণ!
দেখতে দেখতে অন্ধকার হয়ে গেল। অন্ধকারে আমরা হাতড়ে হাতড়ে কাজ করি। আঁখির মাঝে আর আমাদের মাঝে তখন আর কোনো পার্থক্য থাকে না। আঁখি তখন গর্তটা পরীক্ষা করে আমাদের বলে দেয় কোনদিকে কতোটুকু গর্ত করতে হবে। আমরা সেদিকে গর্ত করি। রাতে আমাদের কিছু খেতে দিল না। একেবারে কিছু দিল না সেটা সত্যি নয়, ঘরের জানালা দিয়ে কিছু কলা ধরিয়ে দিল। মোটা মোটা কলা, খেতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম পুরোটাই বিচি দিয়ে ভরা। কলার যে বিচি থাকে আমরা সেটাই কোনোদিন জানতাম না। এক কামড় কলা খেতে হলে পুটুর পুটুর করে একশটা বিচি মুখ থেকে ছুঁড়ে দিতে হয়–ভারি যন্ত্রণা। বাসায় রাত্রি বেলা ভালো করে খাওয়ার জন্যে আম্মু কতোরকম সাধাসাধি করেন–আর এখানে রাতের খাবার হচ্ছে জন প্রতি একটা করে বিচিকলা, কপাল আর কাকে বলে।
তবে সেই বিচিকলা খেয়েই আমরা কাজ করে গেলাম। গভীর রাতে যখন বাইরের মাটি ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে গর্তটা বের হয়ে এলো আমরা তখন ঘরের ভেতরে এতোটুকু শব্দ না করে আনন্দে নাচানাচি করতে থাকি। কাদের বক্স আর তার দলের নাকের ডগা দিয়ে আমরা এখন পালিয়ে যাব!