সাথে সাথে আমরা রিতুকে ঘিরে ধরলাম, “বাইরে কী দেখলি?”
“ঐ গাছগুলোর পিছনে আরেকটা ছোট ঘর। কাঠের চুলা আছে, সেখানে রান্নাবান্না হয়। একজন বুড়ো মানুষ রান্না করছে। কয়েকজন মানুষ বন্দুক হাতে
জায়গাটা পাহারা দিচ্ছে। দূরে আরো একটা ঘর আছে।”
“সব মিলিয়ে তোজন মানুষ?”
“এখন দশ জনের মতো। কয়েকজন খাচ্ছে। খেয়ে বের হবে।”
“রাস্তা আছে?”
“হ্যাঁ। একটাই রাস্তা, ডানদিক দিয়ে। নিচে নেমে গেছে।”
“আর আমাদের ঘরে তালা মেরে বাইরে একটা খুঁটির সাথে চাবি ঝুলিয়ে রাখে।”
আঁখি বলল, “আয় আমরা আগে খেয়ে নিই।”
রিতু বলল, “হ্যাঁ। সবাই ভালো করে খা।”
গামলা বোঝাই খিচুড়ি। মানুষগুলো খাবার নিয়ে কিপটেমি করেনি, নিজেরা যে পরিমাণ খায় সে হিসেবে দিয়েছে। আমরা যে অনেক কম খাই সেটা লোকগুলো জানে না। আমরা সবাই একটা করে টিনের প্লেট নিলাম, শান্তা বড় একটা চামচ দিয়ে আমাদের প্লেটে খাবার তুলে দিল।
খিচুড়িটা বিস্বাদ। লবণ নেই এবং ভয়ানক ঝাল। মাত্র একদিন আগেই আমরা ডাইনিং রুমের বিশাল টেবিলে বসে নাস্তা করেছি, ঝকঝকে গ্লাস, ধবধবে সাদা ন্যাপকিন। অরেঞ্জ জুস, টোস্ট, মাখন, জেলি, ডিম পোচ, দুধ, সিরিয়াল, আপেল, কলা আর গরম চা দিয়ে নাস্তা করেছি। এখন নাস্তা করছি শুধু খিচুড়ি দিয়ে! সেটাও বিস্বাদ আর ঝাল।
সবার জন্যে একটা মাত্র পানির গ্লাস, যে পানিটা দিয়েছে সেটা কোথা থেকে এনেছে জানি না। তারপরেও আমরা পানি খেলাম, যখন তেষ্টা পায় তখন পানি খেয়ে থাকা যায় না।
খাওয়া শেষ হবার পর আমি লক্ষ করলাম আঁখি খিচুড়ির বড় চামচটা হাতে নিয়ে সেটা হাত দিয়ে পরীক্ষা করছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী করছিস?”
“এই চামচটা পরীক্ষা করছি। বেশ বড় আর শক্ত।”
“তাতে কী হয়েছে?”
“আমাদের এই ঘরের মেঝেটা মাটির। তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“আমরা গর্ত করে বের হয়ে যাই না কেন?”
আমরা সবাই আঁখির দিকে তাকালাম। আঁখি চামচটা ঘ্যাঁচ করে মাটিতে বসিয়ে এক খাবলা মাটি তুলে ফেলল। বলল, “দেখলি, মাটি কাটা যায়।”
সুজন বলল, “গর্ত করব? সেই গর্ত দিয়ে বের হওয়া যাবে?”
“হ্যাঁ।”
আমি বললাম, “চোরেরা যেভাবে সিধ কেটে ঢুকে?”
আঁখি বলল, “হ্যাঁ।”
“যদি ধরা পড়ি?”
“ধরা পড়া যাবে না।”
শান্তা বলল, “এই চামচটা তো ফিরিয়ে দিতে হবে।”
রিতু বলল, “এখানে আরো চামচ আছে। আমাকে যদি বের হতে দেয় আমি চুরি করে আরেকটা নিয়ে আসব।”
আমি হাতে কিল দিয়ে বললাম, “ফ্যান্টাস্টিক। ফাটাফাটি বুদ্ধি!”
শান্তা জিজ্ঞেস করল, “মাটিগুলো কী করব? গর্ত করলে যে মাটি বের হবে সেগুলো?”
আমরা থতমত খেয়ে গেলাম, সত্যিই তো, এতগুলো মাটি কী করব? লোকগুলো যদি দেখে ঘরের ভিতর এতো মাটি তা হলেই বুঝে যাবে। আমরা সবাই মাথা চুলকাতে থাকি তখন মামুন বলল, “আমরা যদি দুই ফুট ব্যাসে একটা গর্ত করি, গর্তটা যদি তিন ফুট লম্বা হয় তা হলে মোট মাটি কাটা হবে দশ কিউবিক ফুট। এই ঘরটা হচ্ছে আনুমানিক চার থেকে পাঁচশ বর্গফুট। যদি আমরা
মাটিটা সারা ঘরে সমানভাবে ছড়িয়ে দিই তা হলে মেঝেটা বড় জোর এক ইঞ্চির চারভাগের একভাগ উঁচু হবে! কেউ বুঝতে পারবে না।”
রিতু বলল, “ভেরি গুড, সায়েন্টিস্ট সাহেব!”
আঁখি বলল, “তা হলে দেরি করে কাজ নেই। কাজ শুরু করে দিই।”
আমি বললাম, “হ্যাঁ, চুপ করে বসে বসে অপেক্ষা করা খুব কঠিন।”
রিতু বলল, “তা হলে ঠিক করে নে, ঠিক কোথায় গর্ত শুরু করব।”
“দেয়ালের খুব কাছ থেকে গর্ত করতে হবে। তা হলে তাড়াতাড়ি বের হওয়া যাবে। যেদিকে বের হব সেদিকে যেন মানুষজন হাঁটাহাঁটি না করে।”
রিতু বলল, “সামনে আর ডান পাশে মানুষ থাকে। পিছনে জঙ্গল, মানুষ নেই।”
কাজেই আমরা পিছনের দিকে একটা জায়গা বেছে নিয়ে কাজ শুরু করলাম। একজন চামচ দিয়ে মাটি কাটে অন্যজন মুঠি করে মাটিটা নিয়ে ঘরে ছিটিয়ে দেয়। আরেকজন সেটা পা দিয়ে চেপে সমান করে দেয়। একজন হাতে একটা কম্বল নিয়ে রেডি থাকে-হঠাৎ করে কেউ যদি চলে আসে তা হলে গর্তের উপর কম্বলটা বিছিয়ে দেবে। বাকি দুজন পাহারা, আশেপাশে কাউকে আসতে দেখলেই ইশারা করে তখন আমরা থেমে যাই। কেউ যেন কোনো রকম শব্দও শুনতে না পায়।
এর মাঝে সবচেয়ে কঠিন মাটি কাটা। চামচ না হয়ে যদি একটা খন্তা কিংবা কোদাল পেতাম তা হলে কী সহজে কাজটা করা যেত। যদি খন্তা কোদাল না হয়ে একটা খুরপিও পেতাম তা হলেও কাজটা দশগুণ সহজ হয়ে যেত। কিন্তু আমরা সেগুলো নিয়ে এখন মাথা ঘামালাম না-হাতের কাছে যেটা পেয়েছি সেটা নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি।
কাজ শুরু করার দুই ঘণ্টা পর্যন্ত এমন কোনো গর্তই হল না, আমাদের সন্দেহ হতে লাগল আসলেই আমরা মাটি কেটে সত্যিকারের একটা গর্ত করতে পারব কি না। তৃতীয় ঘণ্টা শুরু করার পর প্রথমবার মনে হতে লাগল যে কাজটা আসলেই শেষ করা সম্ভব। আমরা যে গতিতে মাটি কেটে যাচ্ছি তাতে মনে হয় রাত বারোটার ভিতরেই আমরা গর্তটা শেষ করে ফেলতে পারব। যদি কোনোভাবে আরো একটা চামচ বা ধারালো কিছু পেয়ে যেতাম তা হলে কাজটা আরো তাড়াতাড়ি শেষ করা যেত।
দুপুরের ভিতর বেশ বড় একটা গর্ত হয়ে গেল। এখন আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে সত্যিই একটা গর্ত তৈরি করে ফেলতে পারব। এরকম সময় দরজায় শব্দ হল এবং বেশ কয়েকজন মানুষ ঘরের ভিতরে ঢুকল। আমরা খুব তাড়াতাড়ি কম্বল দিয়ে জায়গাটা ঢেকে দিয়েছি।