আমি ভেবেছিলাম সারা রাত নিশ্চয়ই আমি ঘুমাতে পারব না কিন্তু ভোর রাতের দিকে আমার চোখে ঘুম নেমে এল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমি স্বপ্নে দেখলাম আমি বাসায় আমার বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা গল্পের বই পড়ছি, আমার আম্মু তখন প্লেটে করে আমার জন্যে ঝাল করে মাখানো মুড়ি নিয়ে এসেছেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা তিতু তোদের না কি কাদের বক্স ধরে নিয়ে গিয়েছিল?” আমি হি হি করে হেসে বললাম, “কী বলছ আম্মু? কাদের বক্স কেন আমাদের ধরে নেবে? এই দেখ না আমি বাসায় আমার বিছানায় বসে আছি?”
ঠিক তখন আমার ঘুম ভেঙে গেল আর আমি বুঝতে পারলাম আমি বাসায় আমার বিছানায় বসে নাই। আমাকে আর অন্য সবাইকে কাদের বক্স ধরে এনেছে। আমি বুকের ভেতর ভয়ংকর এক ধরনের চাপা আতঙ্ক অনুভব করলাম। বাইরে নিশ্চয়ই আলো হয়েছে কারণ ঘরের ভেতরেও এখন আবছা আলো। ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে অন্যেরা গুটিশুটি মেরে বসে আছে। আমার মতোন সবাই নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমি উঠে জানালার কাছে এগিয়ে গেলাম, জানালা না বলে সেটাকে বরং একটা ফুটো বলা ভালো, আমি সেই ফুটো দিয়ে বাইরে তাকালাম। আমাদের রাতেরবেলা চোখ বেঁধে এনেছে তখন কিছু দেখতে পাইনি। এখন দেখা যাচ্ছে জায়গাটা দুটো টিলার মাঝখানে, চারপাশে গাছগাছালি দিয়ে ঢাকা। সামনে আরেকটা ঘর, সেই ঘরের বারান্দায় একটা মানুষ বসে সিগারেট খাচ্ছে। এই মানুষটা নিশ্চয়ই পাহারা দিচ্ছে, তার ঘাড়ে একটা ভয়ংকর দেখতে রাইফেল। এটাকে নিশ্চয়ই এ কে ফোর্টি সেভেন বলে। আমি তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ঘরের দরজাটি খুলে গেল এবং ভিতর থেকে খালি গায়ে একজন মানুষ বের হয়ে আসে, আমি মানুষটিকে চিনতে পারি-কাদের বক্স। কাদের বক্স বগলের তলা দিয়ে ঘ্যাস ঘ্যাস করে খানিকক্ষণ চুলকায় তারপর পাহারায় থাকা মানুষটির কাছ থেকে একটা সিগারেট নেয়। সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে সে আবার ভিতরে ঢুকে গেল। আমি খানিকটা ধমকাধমকির শব্দ শুনলাম তখন ভেতর থেকে আরো কয়েকজন মানুষ ঘুম ঘুম চোখে বের হয়ে এল। এই ঘরটায় কাদের বক্স মনে হয় তার বডি গার্ডদের নিয়ে ঘুমায়।
“কী দেখছিস?” গলার স্বর শুনে আমি ঘুরে তাকালাম, রিতু আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
“কিছু না। জায়গাটা কীরকম, কারা কোথায় থাকে এইসব।”
“দেখি?”
আমি সরে দাঁড়িয়ে বললাম, “দেখ কিন্তু মনে রাখিস তুই কিন্তু আসলে দেখতে পাস না।”
“জানি।” রিতু বলল, “ঐ মানুষগুলোর সামনে আমি সবসময়ই না দেখার ভান করব। চিন্তা করিস না।”
যখন খানিকটা বেলা হল এবং আমরা সবাই উঠে জড়সড় হয়ে বসে আছি তখন হঠাৎ করে দরজায় শব্দ হল। আমরা টের পেলাম কেউ একজন দরজার তালা খুলছে। কাঁচক্যাচ শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল এবং আমরা দেখলাম ভয়ানক চেহারার একজন মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটা হুংকার দেওয়ার মতো শব্দ করল, বলল, “কানা মেয়েটা কই?”
রিতু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “এই যে।”
“তুই আয়। অন্যেরা খবরদার ঘর থেকে বের হবি না।”
রিতু জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
“নাস্তা নিয়ে আসবি।”
“আমি?”
“হ্যাঁ।”
আমি বললাম, “ও তো চোখে দেখতে পায় না, ওর বদলে আমি আসি?”
“ও চোখে দেখে না বলেই ওরে আনতে বলছি। তুই চোখে দেখিস তাই চোখ না বেঁধে তোকে ঘর থেকে বের করব না। বুঝেছিস?”
আমি কোনো কথা বললাম না। লোকটা রিতুর হাত ধরে বাইরে নিয়ে আবার দরজা বন্ধ করে দিল। আমরা ঘরের ফুটো দিয়ে তাকালাম, দেখলাম রিতু চোখে দেখতে পায় না এরকম অভিনয় করে খুব সাবধানে মানুষটার সাথে সাথে হেঁটে কয়েকটা গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর সে হাতে একটা মাঝারি সাইজের গামলা নিয়ে খুব আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে আসে। তার পিছনে পিছনে সেই ভয়ানক চেহারার মানুষটা আসছে। মানুষটা ঘরের দরজা খুলে দিল, রিতু সাবধানে গামলাটা মেঝেতে রাখল। মানুষটা বলল, “যা এখন থালা বাসন নিয়ে আয়। পারবি না?”
রিতু মাথা নাড়ল, বলল, “পারব। একটা লাঠি হলে আরো ভালো হত।”
মানুষটা বেঁকিয়ে উঠে বলল, “নবাবজাদির লাঠি লাগবে! যা যা এমনি এমনি যা।”
রিতু তখন এমনি এমনি রওনা দিল। মানুষটা এবারে আমাদের ঘরের দরজায় বসে রিতুর দিকে তাকিয়ে থাকে। রিতু পা ঘষে ঘষে হাত দিয়ে সামনে কী আছে অনুভব করার চেষ্টা করতে করতে এগিয়ে যায়। আবার কয়েকটা গাছের আড়ালে সে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর আবার সে হাতে কয়েকটা টিনের প্লেট আর চামচ নিয়ে ফিরে এলো। চোখে না দেখার নিখুঁত অভিনয়–আমরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
রিতুকে আরো একবার যেতে হল, এবারে সে একটা পানির জগ আরেকটা গ্লাস নিয়ে এল। ঘরের ভেতরে আবার আমাদের তালা মেরে বন্ধ করার আগে মানুষটা রিতুকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, তোর চোখ তো ভালো আছে, দেখিস না কেন?”
“অপটিক নার্ভ নষ্ট।”
“সেটা আবার কী?”
“চোখ থেকে যে নার্ভ ব্রেনে সিগন্যাল পাঠায় সেটা নষ্ট।”
“কীভাবে নষ্ট হল?”
“যখন ছোট ছিলাম তখন একবার অসুখ হয়েছিল। ডাক্তার ভুল ওষুধ দিয়েছিল। সেই ওষুধের রি-একশান।”
মানুষটা জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বলল, “হারামজাদা ডাক্তার।”
রিতু বলল, “ইচ্ছা করে তো দেয় নাই। ভুল করে দিয়েছিল।”
“একই কথা।” বলে লোকটা ধরাম করে দরজা বন্ধ করে ঘটাং করে তালা মেরে দিল।