ভয়ে আতঙ্কে আমাদের সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল।
.
১২.
যখন আমরা জানতে পারলাম ছোট একটা ঘুপচি ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে কেমন লাগে
আমাদেরকে একটা ঘরের মাঝে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা মেরে দিয়েছে। ঘরের ভেতরে কোনো আলো নেই। একটা ছোট জানালা আছে, সেই জানালা দিয়ে বাইরের আবছা আলো ভেতরে একটুখানি এসে মনে হয় অন্ধকারটাকে আরো জমাট বাঁধিয়ে দিয়েছে।
ঘরের ভেতরে সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম, কী বলব কেউ কিছু বুঝতে পারছি না। সবার আগে কথা বলল রিতু। আমাদের দিকে ঘুরে বলল, “তিতু আর সুজন তোরা আমাদের বলবি কী হয়েছে? কেন কাদের বক্স আমাদের ধরে এনেছে?”
মামুন বলল, “হ্যাঁ। আমরা কেউ কিছু জানি না, শুধু তোরা দুইজন জানিস।”
শান্তা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “তোরা কোনো একটা ঝামেলা করবি আর তার জন্যে আমরা সবাই বিপদে পড়ব? কী করেছিস তোরা?”
আমি বললাম, “আমরা কিছুই করিনি–”
শান্তা রেগে গিয়ে বলল, “নিশ্চয়ই করেছিস। তা না হলে আমাদেরকে কেন ধরে এনেছে। বল কী করেছিস?”
সুজন বলল, “আমরা কিছু করি নাই।”
মামুন বলল, “মিথ্যা কথা বলবি না। কী করেছিস বল?”
সুজন বলল, “দেখতে চাচ্ছিলাম টুকরিতে কী আছে। আগে জানলে কি দেখার চেষ্টা করি? গ্রেনেড কেন নিবে টুকরিতে-বুড়ো মানুষটা কীরকম বেয়াদপের মতো কথা বলছিল দেখিসনি, জাবেদ চাচাকে খুঁজছিলাম–”
সুজনের এই ছাড়া ছাড়া মাথামুণ্ডুহীন কথাবার্তা শুনে কেউ কিছু বুঝতে পারল তাই আমাকে পুরো ব্যাপারটা বলতে হল। তখন সবার রাগটা আমার উপর থেকে সরে গিয়ে পুরোপুরি সুজনের উপর পড়ল। শান্তা চিৎকার করে বলল, “তুই তুই তুই–” তারপর রেগে সুজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল, আমরা কোনোমতে তাকে থামালাম। তখন শান্তা হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল, বলতে লাগল, “আমাদের এখন কী হবে! হায় ভগবান! কী হবে আমাদের?”
আমরা কী বলব বুঝতে পারলাম না। মামুন বলল, “কী হবে? আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে! তা না হলে হাত-পা ভেঙে লুলা বানিয়ে বিক্রি করে দেবে–”
শান্তা বলল, “এই অন্ধকারের মাঝে আমাদের ফেলে রেখেছে, কিছু দেখতে পাই না”
আঁখি এতোক্ষণ কোনো কথা বলেনি, এই প্রথম সে কথা বলল। শান্তার হাত ধরে বলল, “কাঁদে না শান্তা। ছিঃ! কাঁদে না।”
“কেন কাঁদব না? এখন আমাদের কী হবে?”
“আমাদের যে ধরে এনেছে সেটা এতক্ষণে জানাজানি হয়নি? নিশ্চয়ই হয়েছে। পুলিশ মিলিটারি কি আমাদের খুঁজতে শুরু করেনি? নিশ্চয়ই করেছে। আগে হোক পরে হোক তারা আমাদের পেয়ে যাবে।”
শান্তা কান্না একটু কমিয়ে বলল, “সত্যি?”
“হ্যাঁ সত্যি। আমি তো আমার আব্বুকে জানি, আমার আব্বু এদের ছেড়ে দেবে ভেবেছিস? ছাড়বে না, খুঁজে বের করবেই। তাই কাঁদিস না। শুধু শান্ত হয়ে অপেক্ষা কর।”
“এই ঘুটঘুঁটে অন্ধকার–”
আঁখি বলল, “তোদের কাছে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। আমার কাছে কোনো পার্থক্য নেই। তাই বলছি আয় আমরা সবাই মিলে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করি কী করা যায়। কেঁদে লাভ নেই।”
“এই পাজি সুজনটার জন্যে–”
আঁখি বলল, “কেন সুজনকে দোষ দিচ্ছিস? এটা তো সুজনের দোষ নয়। এই বদমাইশ মানুষগুলোর দোষ। এরা খারাপ মানুষ।”
আঁখির কথায় শেষ পর্যন্ত শান্তা একটু শান্ত হল। আমরা সবাই তখন গোল হয়ে বসলাম কী করা যায় চিন্তা করার জন্যে। বসে বসে আমরা পুরো ব্যাপারটা নিয়ে কথা বললাম, কিন্তু ঠিক কী করা যাবে ভেবে পেলাম না। শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার থাকল না। তাই আমরা ছোট ঘরটার দেয়ালটায় পিঠ দিয়ে হেলান দিয়ে বসে বসে সকাল হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
সেই রাতটা ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর রাত। মাত্র একদিন আগেই আমরা নিজেরা নিজেরা কথা বলছিলাম যে আমরা কী আনন্দে আছি! কী সুন্দর রিসোর্ট, ডাইনিং রুমে কী মজার খাবার, কী সুন্দর নরম তুলতুলে বিছানা, কী চমৎকার পরিষ্কার বাথরুম। আমাদের কোনো কিছুই নিজেদের করতে হচ্ছে, কেউ না কেউ আমাদের জন্যে সবকিছু করে দিচ্ছে। সেই অবস্থা থেকে আমরা এসে পড়েছি এই জায়গায়। পেটে খিদে নিয়ে অন্ধকার ঘরে বসে আছি। ঘরের ভেতর দিয়ে পোকামাকড় ইঁদুর ছুটে বেড়াচ্ছে। মশার কামড়ে চুপ করে বসে থাকা যায় না। কুটকুটে দুটো কম্বল দিয়েছে সেই কম্বলে দুর্গন্ধ, শরীরের কোথাও ঘষা লাগলে মনে হয় শরীরের ছাল উঠে যাবে।
সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে বাথরুমটা। ঘরের এক কোনায় মাটিতে একটা গর্ত। সামনে একটা ছালা টানিয়ে রেখেছে। সেটাই হচ্ছে বাথরুম। সেখানে ভয়ংকর একটা দুর্গন্ধ। সারা ঘরে সেই দুর্গন্ধ পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে।
আমরা সারা রাত ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে রইলাম। মাঝে মাঝে দুই-এক মুহূর্তের জন্যে চোখ বন্ধ হয়েছে আবার চমকে জেগে উঠেছি। যখন চোখ বন্ধ হয়েছে তখন ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছি। স্বপ্ন দেখেছি কাদের বক্স রাইফেল তাক করে হা হা করে হাসছে, কী ভয়ংকর সেই হাসি।
যখন নিশুতি রাত তখন আমরা জঙ্গলের নানা পশুপাখির শব্দ শুনতে পেলাম, কী বিচিত্র তাদের ডাক। কোনো কোনো পশুর গলার আওয়াজ শুনলে মনে হয় বুঝি কেউ চিৎকার করে কাঁদছে। পাখি ডানা ঝাঁপটে উড়ে যায় এবং মাঝে মাঝে বহু দূর থেকে কোনো এক ধরনের ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পাই, মনে হয় বহু দূরে নদী দিয়ে স্পিড বোট যাচ্ছে। আমাদের খুঁজতে পুলিশ বের হয়েছে কী না কে জানে।