আমাদের কেউ বলে দেয়নি, কিন্তু আমরা বুঝতে পারলাম চেয়ারে পা তুলে বসে থাকা মানুষটা নিশ্চয়ই কাদের বক্স। কী ভয়ংকর! লোকটার চেহারা দেখলেই বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠে।
ভয়ংকর চেহারার মানুষটা বুড়ো মানুষটার কপালে রিভলবারটা দিয়ে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, “এখন দেখা যাক তুমি সত্যি কথা বলেছ না মিথ্যা কথা বলেছ।”
বুড়ো মানুষটা বলল, “আমি সত্যি কথা বলেছি। কাদের ভাই। আপনি ছেলেমেয়েগুলোরে জিজ্ঞেস করেন।”
“সেই জন্যেই তো ওদের ধরে আনলাম। আমি সব সহ্য করতে পারি কিন্তু দলের মাঝে বেইমানি সহ্য করতে পারি না। আমার জানা দরকার বুড়ো তুমি বেইমানি করেছ কি না!”
“করি নাই।”
“যদি দেখি তুমি করেছ তা হলে এখানেই শেষ। ঠিক আছে?”
বুড়ো মানুষটি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “ঠিক আছে কাদের ভাই।”
“এই পোলাপানের মুখের কথার ওপর নির্ভর করছে তোমার জীবন।”
বুড়ো মানুষটি কোনো কথা না বলে কেমন যেন আতঙ্কিত দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। কাদের বক্স এইবার ভালো করে আমাদের দিকে তাকাল, তারপর বলল, “তোমাদের মাঝে না কি একজন অন্ধ! কই আমার কাছে তো কাউরেই অন্ধ কানা মনে হচ্ছে না।”
আমাদের কিছু বলার আগেই কমবয়সী একজন হাত দিয়ে রিতুকে দেখিয়ে বলল, “ওস্তাদ। ডানদিকের মেয়েটা অন্ধ।”
“তুই কেমন করে জানিস?”
“আমি হোটেলে দেখেছি।”
রিতু কিছু বলল না। আঁখিও কিছু বলল না। কাজটা ভালো হল কিনা বুঝতে পারলাম না, কিন্তু আমরাও চুপ করে রইলাম।
কাদের বক্স বলল, “ঠিক আছে কানাবিবি তুমি ডানদিকে সরে যাও।”
রিতু ডান দিকে সরে গেল, চোখে দেখতে না পেলে মানুষ যেভাবে সরে যায় অনেকটা সেভাবে। কাদের বক্স এবারে আমাদের পাঁচজনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা বাকি পাঁচজন এবারে আমাকে একটা সত্যি কথা বল। খবরদার মিথ্যা কথা বলবে না।” কাদের বক্স তখন বুড়ো মানুষটাকে দেখিয়ে বলল, “তোমরা কী এই বুড়োটাকে আগে দেখেছ?”
আমরা মাথা নাড়লাম।
”কখন দেখেছ?”
সুজন বলল, “আমাদের গাড়িতে সবজির টুকরি তুলেছিল।”
“ঐ সবজির টুকরিতে কী ছিল?”
আমি বললাম”গ্রেনেড।”
আমার কথা শুনে আমাদের অন্য সবাই ভয়ানকভাবে চমকে উঠল। তারা অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকাল। কাদের বক্স সন্তুষ্টির ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল, তার ভাব দেখে মনে হল আমরা যে ব্যাপারটা জানি সেটা জেনে সে খুশি হয়েছে। মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “এখন তোমরা আমাকে বল, তোমরা কি ঐ টুকরি থেকে গ্রেনেড সরিয়েছ?”
সুজন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। সরিয়েছি।”
বুড়ো মানুষটা হাতবাঁধা অবস্থায় লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করে বলল, “বলেছি না আমি? বলেছি না?”
কাদের বক্স গম্ভীর মুখে বলল, “এতো লাফিও না বুড়া মিয়া। এখন আমার শেষ প্রশ্ন। এই প্রশ্নটার উত্তরের উপর নির্ভর করছে তোমার মাথার ভিতর দিয়ে গুলি যাবে না কি যাবে না।” কাদের বক্স আমাদের দিকে তাকাল, তারপর মুখ শক্ত করে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কয়টা গ্রেনেড সরিয়েছ?”
বুড়ো মানুষটার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল, সে ভয় পাওয়া চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি সুজনের দিকে তাকালাম তারপর কাদের বক্সের দিকে তাকিয়ে বললাম, “দুইটা।”
বুড়ো মানুষটা আনন্দে চিৎকার করে উঠে বলল, “দেখেছেন কাদের ভাই? দেখেছেন? আমি গ্রেনেড সরাই নাই। এই পাজি বদমাইশ ছেলেমেয়েগুলো সরিয়েছে।”
কাদের বক্স কিছুক্ষণ বুড়ো মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর অন্যদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “বুড়ার হাতের বাঁধন খুলে দে।”
একজন এসে তার বাঁধন খুলে দেয় এবং সাথে সাথে সে দাঁড়িয়ে বলে, “কাদের ভাই, আপনি একটু অনুমতি দেন আমি পাজি ছেলেমেয়েগুলোকে পিটিয়ে লাশ করে দেই।”
কাদের বক্স বলল, “তার অনেক সময় পাবে বুড়া।” তারপর ঘুরে আমাদের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল, “গ্রেনেড দুইটা এখন কোথায় আছে?”
আমরা কোনো কথা বললাম না, তখন কাদের বক্স ধমক দিয়ে উঠল, “কোথায় আছে?”
“আমাদের রুমের পিছনে ফেলে দিয়েছি।”
কাদের বক্স আগুনের মতো জ্বলন্ত চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। হুংকার দিয়ে বলল, “রুমের পিছনে কোথায়?”
“বড় বড় দুইটা গাছ আছে, তার সাথে ঝোঁপ। সেই ঝোঁপের নিচে।”
কাদের বক্স একজনের দিকে তাকিয়ে বলল, “চান্দু। তোর উপর দায়িত্ব, গ্রেনেড দুইটা খুঁজে বের করে নিয়ে আসবি।”
চান্দু নামের মানুষটা মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে”স্তাদ।”
এতোক্ষণ আমি আর সুজন ছাড়া আমাদের আর কেউ কথা বলে নাই। এবারে রিতু কথা বলার চেষ্টা করল, বলল, “এখন কি আমরা যেতে পারি?”
কাদের বক্স বলল, “কী বললে?”
“আপনাদের যেসব প্রশ্ন ছিল তার সবগুলোর উত্তর তো জেনে গেছেন। এখন আমাদের কি ফিরিয়ে দিয়ে আসবেন?”
কাদের বক্স কিছুক্ষণ রিতুর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর হা হা করে হাসতে শুরু করল। কাদের বক্সের হাসি দেখে অন্যেরাও হাসতে শুরু করে, যেন তারা খুব মজার কথা শুনেছে। হাসতে হাসতে কাদের বক্সের চোখে পানি চলে আসে। একসময় সে হাসি থামায়, তারপর টেনে টেনে বলে, “শুনো কানা মেয়ে। পৃথিবীতে দুইটা জিনিসের ব্যবসায় মুনাফা সবচেয়ে বেশি। একটা হচ্ছে অস্ত্র আরেকটা হচ্ছে মানুষ! আমি অস্ত্রের ব্যবসাও করি মানুষের ব্যবসাও করি। ছেড়ে দেবার জন্যে তোমাদের আমি ধরে আনি নাই! তোমাদের বিক্রি করা হবে। বুঝেছ? রেঙ্গুনের মার্কেটে!”