জাবেদ চাচা আর শব্দ করলেন না, মনে হল তার শব্দ করার ক্ষমতাও নেই। গামছায় মুখ বাঁধা একজন মানুষ হাতের রাইফেলটা সবার দিকে তাক করে বলল, “কেউ যদি নড়াচড়া করেছ, চিল্লাচিল্লি করেছ তা হলে শেষ।”
কেউ এতোটুকু শব্দ করল না। তখন ছয়জন মানুষ আমাদের ছয়জনকে ধরে টেনে-হিঁচড়ে নিতে থাকে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম লোকগুলো হ্যাঁচকা টান দিয়ে আমাদের সোজা করে নেয়। আমরা এতো ভয় পেয়েছি যে চিৎকার করার শক্তি পর্যন্ত নেই। মানুষগুলো আমাদের নিয়ে রিসোর্ট থেকে বের হয়ে আসে। রাস্তায় দুটো চান্দের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের ধাক্কা দিয়ে একটা চান্দের গাড়িতে তুলে দেয়, আমরা ভালো করে ওঠার আগেই গাড়িটা ছেড়ে দিল। ড্রাইভার পাহাড়ি রাস্তায় ঝড়ের বেগে গাড়িটা চালিয়ে নিতে থাকে। পিছন থেকে দ্বিতীয় গাড়িটাও এর পিছনে পিছনে আসতে থাকে।
কে একজন বলল, “চোখ বেঁধে দে সবগুলোর।”
আমরা অন্ধকারে টের পেলাম মানুষগুলো গামছা দিয়ে আমাদের চোখ বেঁধে দিচ্ছে। এতোক্ষণ আবছা আলোতে চারিদিক দেখতে পাচ্ছিলাম, হঠাৎ করে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল।
পুরো ব্যাপারটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটেছে যে আমরা ভালো করে কিছু বুঝেই উঠতে পারছিলাম না। চান্দের গাড়ির মেঝেতে পা গুটিয়ে বসে আছি, ঝাঁকুনিতে ঠিক করে বসেও থাকতে পারছি না, তার মাঝে শুনলাম, শান্তা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “কী হচ্ছে এখানে! আমাদের কে নিয়ে যাচ্ছে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?”
আমি বললাম, “মনে হয় কাদের বক্সের দল।”
রিতু নিচু গলায় বলল, “কাদের বক্সের দল? কাদের বক্সের দল আমাদের ধরবে কেন?”
সুজন বলল, “কারণ আছে।”
“কী কারণ?”
আমি কারণটা বলতে যাচ্ছিলাম তখন একটা মানুষ হুংকার দিল, “খবরদার একটা শব্দ করবি না। খুন করে ফেলব মুখ খুললে।”
আমরা তখন চুপ করে গেলাম। ভয়ে আমরা কেউ ঠিকভাবে চিন্তাও করতে পারছিলাম না। কী হচ্ছে, আমাদের কোথায় নিচ্ছে আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। আমরা নিশ্বাস বন্ধ করে গাড়িতে বসে থাকি।
একসময় হঠাৎ গাড়িটা থেমে গেল। আমরা শুনলাম মানুষগুলো চাপা গলায় কথা বলছে। তারপর টের পেলাম আমাদের গাড়ি থেকে নামাচ্ছে। চোখ বাঁধা, কিছু দেখতে পাচ্ছি না তার মাঝে আমরা একজন একজন করে হাঁটতে লাগলাম। কে সামনে কে পিছনে বুঝতে পারছি না। একজন আরেকজনকে ধরে হাঁটছি। অন্ধকারে পা পিছলে যাচ্ছিল, এক দুইবার হুড়মুড় করে নিচে পড়ে গেলাম। কোনো একজন লোক তখন আমাদের গালাগাল করে টেনে দাঁড় করিয়ে দিতে লাগল। মনে হল নিচে নামছি, নামছি তো নামছিই আর থামাথামি নেই। শেষ পর্যন্ত একসময় থামলাম। পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শুনছি, তার মানে কোনো একটা নদীর কাছে এসেছি। ধাক্কা দিয়ে আমাদের কোনো একটা নৌকায় তুলে দিল তারপর নৌকাটা ছেড়ে দিল।
আমরা নিঃশব্দে নৌকায় বসে রইলাম। মনে হল ঘণ্টার পর ঘণ্টা নৌকায় বসে রয়েছি কোনোদিন বুঝি আর নৌকা থামবে না। শেষ পর্যন্ত নৌকা থামল, একজন জিজ্ঞেস করল, “কয়টা বাজে?” অন্যজন উত্তর দিল”সাড়ে আটটা” তখন আমরা বুঝতে পারলাম আসলে সময় খুব বেশি পার হয়নি। আমাদের কাছে মনে হচ্ছে বুঝি অনন্তকাল।
নৌকা থেকে নামার পর আমরা উপরে উঠতে থাকি। একজনের পিছু আরেকজন, কে সামনে কে পিছনে বুঝতেও পারছি না। অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝেই আমাদের কেউ না কেউ হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল তখন মানুষগুলো আমাদের গালাগাল করতে করতে টেনে তুলছিল। বোঝা যাচ্ছিল আমাদের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে টেনে নিচ্ছে, গাছের পাতা ডাল আমাদের হাতে পায়ে মুখে লেগে যাচ্ছে, হাত-পা কেটেকুটে যাচ্ছে কিন্তু এখন সেগুলো নিয়ে আমরা কেউ মাথা ঘামাচ্ছিলাম না।
শেষ পর্যন্ত আমরা থামলাম, মনে হল কোনো একটা বাসার সামনে দাঁড়িয়েছি। দরজায় কেউ একজন ধাক্কা দিল, ভিতর থেকে কেউ একজন জিজ্ঞেস করল, “কে?”
আমাদের সাথে যারা ছিল তারা বলল, “আমরা। ছেলেমেয়েগুলো ধরে এনেছি।”
খুট করে দরজা খোলার শব্দ হল। আমাদের পিছনে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। আমরা টের পেলাম ভিতরে আরো অনেক মানুষ বসে আছে, সেখানে কেমন যেন ঝাঁঝালো বোটকা একটা গন্ধ। ভারী গলায় কে যেন বলল, “চোখ খুলে দে।”
লোকগুলো আমাদের চোখ খুলে দিল এবং এই প্রথম আমরা পিটপিট করে তাকালাম। ছোট একটা কাঠের ঘর। এক পাশে একটা কাঠের টেবিল, টেবিলের অন্য পাশে একজন একটা চেয়ারে পা তুলে বসে আছে। টেবিলের এক কোনায় একটা হ্যারিকেন দপদপ করে জ্বলছে। অন্য পাশে একটা লম্বা বেঞ্চ, সেখানে কয়েকজন বসে আছে। যে মানুষগুলো আমাদের ধরে এনেছে তারা এখন তাদের মুখে বাঁধা গামছা খুলে ফেলেছে। হ্যারিকেনের অল্প আলোতে সবাইকে কেমন যেন ভয়ানক দেখাচ্ছে।
চেয়ারে পা তুলে বসে থাকা মানুষটা টেবিল থেকে কালোমতোন কী একটা জিনিস হাতে তুলে নিয়ে তার পাশে চেয়ারে বসে থাকা মানুষটার কপালে ধরল। আমরা চমকে উঠে দেখলাম কালোমলতান জিনিসটা হচ্ছে একটা রিভলবার আর যে মানুষটার কপালে ধরেছে তাকেও আমরা চিনে ফেললাম। এটি হচ্ছে সেই বুড়ো মানুষটি যে আমাদের গাড়িতে সবজির টুকরি তুলে দিয়েছিল। আবছা অন্ধকারে ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না বলে আমরা প্রথমে চিনতে পারিনি। এখন দেখতে পেলাম তার হাত দুটো পিছন থেকে বাঁধা।